কল্লোলিনী-তিলোত্তমা বা সিটি অফ জয় ছাড়াও কলকাতার অন্য একটি পরিচয় হল এই শহর দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। লিটল ম্যাগ থেকে নাটক-থিয়েটার, সিনেমা থেকে কুমোরটুলির পটুয়া পাড়া – সব জায়গায় শিল্পের প্রতি একটা আলাদা অনুভুতি, একটা আলাদা জায়গা রয়েছে। এই শহরেই এমন কিছু নামকার থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল হয়, যা দেখার জন্য সারা দেশ থেকে মানুষজন আসেন। এমনকী বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ থেকেও বিভিন্ন থিয়েটার গ্রুপ আসে এখানে পারফর্ম করার জন্য। আজ বিশ্ব থিয়েটার দিবসে দেখে নিন তেমনই কিছু নামকরা থিয়েটার ফেস্টিভ্যালগুলি। পরের বার থেকে ক্যালেন্ডারে অবশ্যই তারিখগুলি লাল দাগ দিয়ে রাখবেন।
১) সংসৃতি থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল (Sansriti Theatre Festival): প্রত্যেক বছর মার্চ মাসে এই থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল হয়। এ বছরও গত ২৪ এবং ২৫ তারিখ ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেল। এ বছর দেবশঙ্কর হালদারের সওদাগরের নৌকা, রজতাভ দত্ত-র তুঘলক, সৌরভ পালোধি এভং শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ের ফ্যাতাড়ু ছাড়াও আরও অন্যান্য কিছু নাটক দিয়ে সাজানো ছিল ফেস্টিভ্যালটি।
২) ন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল, নান্দিকার: এ বছর নান্দিকার আয়োজিত ন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল-এর ৩৩তম বছর উদ্যাপিত হল। সারা দেশে ৮০টি নাটক অভিনীত হয়। যদিও মূল ফেস্টিভ্যালটি হয় কলকাতায়। দেশের বিভিন্ন রাজ্য যেমন, অসম, বিহার, দিল্লি কর্নাটক থেকে বিভিন্ন গ্রুপ এই ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করে। আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকেও থিয়েটার গ্রুপ আসে এখানে অনুষ্ঠান করার জন্য।
৩) ভোডাফোন ওডিওন থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল: গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫তম ওডিওন থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেল। যার মূল উদ্যোক্তা ছিল ভোডাফোন। এখানে রীতিমতো তারকার মেলা বসেছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শরমন জোশি, ব্রাত্য বসু, দেবশঙ্কার হালদার ছাড়াও অনেক নামকার শিল্পীরা এখানে পারফর্ম করেন।
৪) থিয়েটার অলিম্পিকস, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা: সম্প্রতি কলকাতায় অষ্টম থিয়েটার অলিম্পিকস অনুষ্ঠিত হল। অনেকে জিজ্ঞাসা করবেন, থিয়েটার অলিম্পিকস কেন? উত্তর হচ্ছে, প্রায় ২ মাস ধরে দেশের ১৭টি শহর - দিল্লি, চেন্নাই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, তিরুবনন্তপুরম, পাটনা, ভুবনেশ্বর, আগরতলা, গুয়াহাটি, বারাণসী, ভোপাল, মণিপুর, জয়পুর, চণ্ডীগড়, জম্মু, আমদাবাদ এবং মুম্বইয়ে এই থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে ফেস্টিভ্যাল। চলবে আগামী ৮ এপ্রিল পর্যন্ত। কলকাতায় ফেস্টিভ্যাল হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত।
বিশ্ব থিয়েটার দিবসে জানুন কলকাতার নাম করা থিয়েটার ফেস্টিভ্যালগুলি
কখন বৃষ্টি আসবে, তারই প্রতীক্ষা
প্রথমেই বলা দরকার, এই নাটক অমর মিত্রের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি৷
অমরবাবুর বহু উপন্যাসই কাব্যিক গুণে জারিত৷ আর সেই ধারারই অন্তর্গত এই কাহিনি৷ বৃষ্টি -অনাবৃষ্টি , প্রেমপ্রস্তাবে ‘না’ শুনে গৃহত্যাগী যুবক, অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন নগরীর বাসিন্দারা, গান .. বিশ্বাস .. অবিশ্বাস .. জাতিভেদ সব মিলে গোড়া থেকেই কাহিনির মধ্যে কাব্যিক দ্যোতনা রয়েছে৷ আর সেই জায়গাটা ধরেই নাটক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন কিশোর সেনগুন্ত৷ ‘নুরুলদীনের সারাজীবন ’ নাটকে তিনি ড্রয়িংরুম ড্রামা থেকে বেরিয়ে যে একটা অন্য খাতে নিজের পরিচালনাকে বওয়াতে চেয়েছেন , তারই অংশীদার এই নাটক৷ ঘটনার স্বাভাবিক নাটকীয়তা , কাব্যগুণ , ইতিহাস আঙ্গিক হাত মিলিয়েছে নাটকে৷
প্রেক্ষাপট তথা কাহিনি এরকম: কথিত আছে বহুকাল আগে উজ্জ্বয়িনী নগরীতে এক গণিকার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হন এক কবি৷ তিনি এক নদীতে আত্মহত্যা করতে যান৷ কিন্ত্ত দেবী সরস্বতী নিজে তাঁকে সেই চেষ্টা থেকে বিরত করেন৷ ক্রমে কবি চলে যান উত্তরে আর্যাবর্তে৷ যান দশার্ণের পথে৷ অনুসন্ধান করেন কুরুক্ষেত্র-কঙ্খল৷ এই নাটকটির আখ্যান আরম্ভ এরকমই এক বিরহের পটভূমিকায়৷ বীণা বাজিয়ে মেঘ ও বৃষ্টির আখ্যান গাইতো যে ধ্রুবপুত্র, চৈত্র পূর্ণিমার রাতে সে একদিন চলে গিয়েছিল অভিমানে , অপমানে৷ রাজদণ্ডের প্রতি ভরসা হারিয়ে যাত্রা করেছিল দূর দেশে৷ আর সেদিন থেকে বৃষ্টির কালো মেঘও যেন উদাসীন হয়ে পড়েছে উজ্জ্বয়িনীর রমণীদের৷ ভুলে গিয়েছে শিপ্রা নদীর কুল , কণকশৃঙ্গ মহাকালেশ্বরের মন্দির৷ কিন্ত্ত অনাবৃষ্টির কারণে তৈরি হওয়া সঙ্কটের প্রতিকারের চেষ্টা না করে মূলত তার কারণ অনুসন্ধানেই বিভ্রান্ত উজ্জ্বয়িনীর রাজা ভর্তৃহরি৷ বাস্তবকে ভুলে তিনি আশ্রয় নেন দৈবের৷ আর এখানেই মহাকালের পরিহাস স্পষ্ট হয়৷ ক্ষত্রিয়ের সেই ক্ষাত্র তেজই যেন নতিস্বীকার করে ব্রাহ্মণ্যশক্তির অমোঘ বিধানের কাছে৷
এবার শ্রুতিনাটকেও সাহেব-বিবি-গোলাম
'সাহেব বিবি গোলাম'- বিমল মিত্রের এই বহুলচর্চিত উপন্যাসের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। বড় পর্দায় গুরুদত্ত, মীনা কুমারী ও ওয়াহিদা রেহমান অভিনীত এই ছবি দেখেননি এমন দর্শক এদেশে নেই। সেই বিখ্যাত উপন্যাস এবার দর্শকদের জন্যে আসছে শ্রুতিনাটক রূপে।
'অভিব্যক্তি' নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার রঞ্জনা ভঞ্জ'র পরিচালনায় শ্রুতিনাটক হিসেবে প্রথম মঞ্চস্থ হচ্ছে 'সাহেব বিবি গোলাম'। সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক রঞ্জনা সহ শঙ্কর চক্রবর্তী, শঙ্কর রায়চৌধুরী, অলোক রায় ঘটকের মত বাংলা শ্রুতিনাটক জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিরা। রঞ্জনা জানালেন, উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিতে বহুবার এই গল্প পড়েছেন তিনি। 'খুব যত্ন নিয়ে প্রতিটি চরিত্র বাছাইয়ের কাজ করার চেষ্টা করেছি। কোনভাবেই যাতে মূল উপন্যাসের রেশ না হারিয়ে যায়,সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হয়েছে।' তবে সিনেমার কথা ভুলে সম্পূর্ণ নতুন মন নিয়ে শ্রুতিনাটকটি শুনতে আসার আবেদন জানিয়েছেন অভিনেতা শঙ্কর চক্রবর্তী।
ইদানিং শ্রুতিনাটক নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষামূলক কাজ হচ্ছে। তেমনই একটি প্রয়াস সাহেব বিবি গোলাম। মঞ্চস্থ হবে ৭ এপ্রিল, রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে।
মঞ্চে একটুকরো মানভূম, ভাদুর আত্মহত্যা এবং...
পুরুলিয়ার কাশীপুর রাজবাড়ির কথা আর সেখানকার রাজকন্যা ভাদুর কথা তো সকলেই শুনেছেন। আসলে এই ভাদুকে নিয়ে নানা মিথ প্রচলিত রয়েছে।
মানভূমের লোকেরা বিশ্বাস করেন ভাদু আত্মহত্যা করেছিলেন। আর তাই পয়লা ভাদ্র গ্রামের কুমারী মেয়েরা কুলুঙ্গী পরিষ্কার করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন। একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে তাঁরা সমবেত কন্ঠে ভাদু গান করেন। ভাদ্র-সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদুর মূর্তি ঘরে নিয়ে আসে। সংক্রান্তির পূর্ব রাত্রে ভাদুর জাগরণ পালা হয়। এদিন রঙিন কাগজের ঘর তৈরি করে ভাদুর মূর্তি স্থাপন করে ভাদুকে জল-মিষ্টি খেতে দেওয়া হয়। এরপর সারারাত জুড়ে হয় ভাদুর বন্দনা গীত। পরদিন সকালে ভাদু বিসর্জন দেওয়া হয়।
কে এই ভাদু? মানভূমের কোনও দেবী নাকি মানবী? তার আসল নাম তবে কি ভদ্রেশ্বরী? ভদ্রাবতী? সামন্ততন্ত্রের উত্তরাধিকার আজও কি মিশে রয়েছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়নে? আসলে নারীবাদের তত্ত্ব আওড়ালেও লিঙ্গ-রাজনীতির ভাবনা থেকে আমরা বেরোতে পারলাম কই.. 'ক্লাস' এবং 'মাসের' ভাবনা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে 'ভাদ্রজা'।
'স্পেক্টঅ্যাক্টর্সে'র নতুন নাটক। নির্দেশনা এবং রচনা সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়। অভিনয়ে সৌম্য, শ্রমণ, বরুণ, আর্যা, অরিজিতা। সঙ্গীত মৃগনাভি চট্টোপাধ্যায়। আসুন, দেখুন, ভাবুন। এক অন্যভাবনার শরিক হতে। ৩ মে ২০১৮, জ্ঞান মঞ্চ, সন্ধ্যা ৬.৩০।
টিকিট পেতে ফোন করুন এখানে: ৭৬৮৫৮৬৬১২৪
চুরি সবের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে
এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুকুমার এক বিখ্যাত চোরের বংশধর৷ তার মাথায় এক আইডিয়া আসে৷ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে সে জেনে নিতে চায় যে কেমন ধরনের একখানা চুরি করলে সে বিখ্যাত হতে পারে৷ সে দেখা করে অনেকের সঙ্গে, কিন্তু উত্তর পাওয়া গেল কি?
সুকুমার যখন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যায়, তখন সামনে চলে আসে নিত্যনতুন প্রোজেক্ট, রাস্তা নির্মাণ, প্রমোটর, সিন্ডিকেট ইত্যাদি নানা বিষয়৷ আর প্রত্যেকটি বিষয়ের সঙ্গেই টাকা-পয়সা লেনদেনের যোগ রয়েছে৷ ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করেও পরিস্থিতি একই দাঁড়ায়৷ সেখানেও কালো টাকার পাহাড়৷ ইধার কা মাল উধার করার কারবার৷ পুলিশের কাছে পৌঁছে আরও এক রকম অভিজ্ঞতা৷ সেখানে বেআইনি নির্মাণ থেকে উপরি রোজগার আছে, প্রচুর ঘুষের টাকা আছে, আবার ঘুষ পাওয়া যাবে এমন এলাকায় পোস্টিং পেতে পুলিশের অভ্যন্তরেও চলছে ঘুষ৷ চিকিৎসকের উপরি পাওনা আসছে অন্য সোর্স থেকে৷ নানা রকম টেস্ট করার জন্য প্যাথোলজি সেন্টার থেকে পার্সেন্টেজ মিলছে৷ স্বল্প প্রয়োজনেও মস্ত অপারেশনের বিল ধরানোর উপায়ও আছে৷ এখানেই শেষ নয়৷ রয়েছে গ্লোবাল এডুকেশন কোচিং সেন্টারও৷ তার দেওয়ালে থরে থরে যুবক-যুবতীর নাম ও ছবি টাঙানো আছে, যারা নাকি এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রস্তুতি নিয়েই মস্ত চাকরি পেয়েছে৷ অথচ বাস্তবে এদের সঙ্গে কোচিং সেন্টারের কোনও সম্পর্কই নেই৷
এই যে সুকুমারের যাত্রা, যেখানে সে দেখে যে 'চুরি' কথাটা খুব সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়, যেন চোর মানেই কেবল সিঁদ কেটে চুরি করবে৷ কিন্তু সেই প্রাচীন ধারণা থেকে বেরিয়ে এলে তো দেখা যাবে এখন চারপাশের প্রতিটা ক্ষেত্রেই 'চুরি' হচ্ছে, অথচ তাকে 'চুরি' বললেই তেড়ে আসছেন অনেকে৷ সুদীপ্ত নতুন পরিচালক হিসেবে নাটক মঞ্চস্থ করতে এসে চমৎকার একটি গল্প বেছে নিয়েছেন৷ সেটা খুব ভালো ব্যাপার৷ এমন গল্প মঞ্চে আসা প্রয়োজন৷ কিন্তু নাটকটা এক্সিকিউট করার জন্য যে উপস্থাপনা প্রয়োগ করলেন, সেটা যেন ঠিক খাপ খেলো না৷ বক্স, বক্সের উপর মোটিফ, কোরাসের হলুদ জামা- এইরকম সব সাজেশনের মধ্যে দিয়ে না গিয়ে কেন জানি না মনে হল আরও সরাসরি উপস্থাপনা আনলে বোধহয় দর্শককে সহজে ছোঁয়া যেত৷
'আমার সন্তান আসছে, খুব গ্ল্যামারাস!'
এই মুহূর্তে আমি খুব খুব সুখী। আমার সন্তান আসছে। তাই তার জন্মের আগে কোনও রকম গাফিলতি রাখতে চাই না। কোনও দৈনতা থাকবে না। আমার হবু সন্তান যে খুব গ্ল্যামারাস। জীবনটাই শুরু করেছি অনেক দুঃখ কষ্ট দিয়ে। তাই কোনও কিছুকেই আমার আর কষ্ট বলে মনে হয় না। সন্তান 'রঙ্গিণী'র জন্মের আগে একান্ত আড্ডায় এভাবেই ধরা দিলেন গার্গী রায়চৌধুরী। ২৭ মে মঞ্চে আসছে রঙ্গিণী। মধ্যিখানের ১০ বছরের বিরতির পর আবার তিনি ফিরছেন। এবারে তাঁর ফেরা মোনোলগ নিয়ে।
হবু সন্তানের জন্য প্রস্তুতি চলছিল প্রায় দেড় বছর ধরে। এই নাটকটি লিখেছেন বিখ্যাত নাটককার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। হচ্ছে না হবে না এই নিয়ে বেশ কিছুদিন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে লড়ে গিয়েছেন তিনি। ভেবেছিলেন এমন কিছু নাম দেবেন নাটকের যাতে খুব সহজেই দর্শক নিজেদের সঙ্গে তাঁর অভিনীত চরিত্রকে মানিয়ে নিতে পারে। এরপর প্রচেত গুপ্ত নামকরণ করলেন রঙ্গিণী। আবহ এবং সুর দিলেন দেবজ্যোতি মিশ্র। কোরিওগ্রাফি করছেন সুদর্শন চক্রবর্তী। পোশাক ভাবনায় দেব-নীল। চোখ ধাঁধানো সেট করছেন নীল-কৌশিক, আলো করছেন সৌমেন এবং পুরো নাটকই খোলনোলচে বদলে দিয়েছেন এরাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। দাবি করলেন গার্গী।
রঙ্গিণী আসলে সেই মেয়েটা। যে রঙ্গ করে। রঙ্গ লিঙ্গ বোঝে না। রঙ্গ ধর্ম বোঝে না। তাই রঙ্গিণী এই জীবনে নতুন করে বাঁচে।
রঙ্গিণী আসলে একা মেয়ের লড়াই। অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে যে এগিয়ে চলে চরৈবেতি মন্ত্রে। নিজের মতো স্থান করে নেয় এই পৃথিবীতে। আসলে তিনি ভিড়ের মাঝে জনতা হতে চান না। জনতার মাঝে একক হতে চান। নিজেকে ভীষণ ভাবে ভেঙেগড়ে বাঁচতে চান তিনি। তাঁর কাছে জীবন মানে রোলার কোস্টার। তবে প্রতি কাজের মাধ্যেই দর্শকের কাছে সামাজিক বার্তা পৌঁছে দিতে চান তিনি। সেই কারণেই তিনি নিজের মত করে কাজ করতে চান। তাই তো নাচ-গান-অভিনয়ে ভরপুর ১ ঘন্টা ১০ মিনিটের মোনোলগে কোথাও ক্লান্ত হয়ে যান না তিনি। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন গার্গী।
তিনি মনে করেন জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা। তাই তো দূরদর্শনের সঞ্চালক থেকে আকাশবাণীর স্টুডিয়ো, থিয়েটার, যাত্রা, সিনেমা সবেতেই তিনি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। আর এই সব অভিজ্ঞতা তিনি কাজে লাগিয়েছেন তাঁর বর্তমান প্রোজেক্টে। তাঁর রঙ্গিণীকে নিয়ে বহুদূর যেতে চান তিনি। থিয়েটার নয়, সিনেমা নয়... তিনি এগিয়ে রাখেন অভিনয়কে। তিনি চান গার্গী রঙ্গিণী সমার্থক হোক। সম্প্রতি বেশ কিছু জায়গায় কাস্টিং কাউচ নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর মত জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাস্টিং কাউচ বলে এখানে কিছুই হয় না। নিজে ঠিক থাকলে জগৎ ঠিক। অভিযোগ না করে নিজে মন দিয়ে কাজ কর। পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই।
ভাদু নিম্নবর্গের নাকি রাজরক্তের
রচনা, নির্দেশনা: সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
দল: স্পেক্টঅ্যাক্টরস
অভিনয়: শ্রমণ, আর্যা, সৌম্য, অরিজিতা, বরুণ
রেটিং: তিন
ইন্দ্রনীল শুক্লা: প্রসেনিয়ামের ভিতর যে শহুরে গপ্প-গাছাওয়ালা থিয়েটারের সাক্ষী আমরা হয়ে থাকি, এ থিয়েটার তেমন থিয়েটার নয়। নিপাট কোনও কান্না কিংবা হাসির কাহিনির সাক্ষী হওয়ার ইন্ধন এখানে নেই। বরং বাঙালির নিজস্ব গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে, ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে এই নাটক। ভাদু! ভাদু গান, পুজো ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদে তো জানার অবকাশ নেই। তবু খোঁজ তো চলতেই থাকে। এ নাটককে সুদীপ্তবাবুর 'ভাদু' অনুসন্ধান হিসেবেই অতএব দেখা ভাল।
নীলকণ্ঠ ঘোষালের 'ভূমিকন্যা' উপন্যাস, সুব্রত চক্রবর্তীর 'ভাদু'-র মতো বইগুলিতে তথ্য বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। সে পথে সুদীপ্তকে হয়তো হাঁটতে হয়েছে, কিন্তু পরিচালকের থেকেই জানা গিয়েছে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট গল্প 'টোপ' অবলম্বনে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র ছবিতে কাজ করার সময়ই 'ভাদু' রেফারেন্স নিয়ে কাজের পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁর। অতএব মশাল নয়, অগ্নিসংযোগে দেশলাই কাঠিই যথেষ্ট।
যে মূলগত প্রশ্ন থেকে খোঁজ শুরু হতে পারে তা হল, মানভূমের ভাদু দেবী নাকি মানবী? তাঁকে খুঁজতে গিয়ে রাজরক্তের সন্ধান যেমন মিলছে, তেমনই চলে আসছে নিম্নবর্গের রেফারেন্সও। তাঁর আসল নাম ভদ্রাবতী নাকি ভদ্রেশ্বরী তা-ও স্পষ্ট নয়। ঘটনাগুলো সত্য নাকি শাশ্বত তা নিয়েও দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। মিথ আর মিথ্যের লড়াই জারি। আছে আরও অনেক প্রশ্ন। ভাদুর গল্প কেবল গল্পেই কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়। নাটকে এই সময়-এর চশমা পরে পুরনো সময়টাকে দেখতে চাওয়া হয়েছে। আর সেখানেই দৃশ্যমান হচ্ছে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামন্ততন্ত্রের জিন কেমন করে বয়ে গিয়েছে 'সিউডো' গণতান্ত্রিক কাঠামোতেও।
যেহেতু, ইতিহাস স্পষ্ট নয়, তাই কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে নাটকে। কেমন সেটা? এসেছে এক রাজবাড়ির কথা। ভাদুর প্রতিষ্ঠায় রাজবাড়ির রহস্যময় ভূমিকা সম্বন্ধে কিছু অনুমান রাখা হয়েছে। এক অরণ্য-কন্যার সঙ্গে এক আদিবাসী যুবকের প্রেম-বনে শিকার করতে এসে সেই হাঁটুর বয়সী কন্যাকে দেখে রাজার কামাতুর হয়ে পড়া এবং লালসা মেটাতে 'বিয়ে বিয়ে' খেলা- পরে মেয়েটি রাজপ্রাসাদে এসে রানির স্বীকৃতি চাইলে তাকে তাড়ানো-ক্রমে বনে ফিরে এসে সেই বনের যুবকের কাছেই আশ্রয় পাওয়া... তারপর আরও অন্য দিকে যাবে কাহিনি। কিন্তু গপ্পোটা বলার জন্য তো এই লেখা নয়। সেটা প্রেক্ষাগৃহের জন্য তোলা থাক।
ট্রিটমেন্ট অনুযায়ী অন্যরকম এ নাটক। এক গবেষক ভাদু সম্পর্কে জানতে এক জমিদার বাড়ি এসেছেন। আর ফ্ল্যাশব্যাকে আমরা পৌঁছে যাবো সেই ইতিহাস, অথবা কল্পনায়। মাত্র পাঁচ জন অভিনেতা এত দ্রুত বেশ পাল্টে সামনে আসেন, যে অবাক হয়ে যেতে হয়। কেন্দ্রীয় চরিত্রে ভারি সুন্দর লেগেছে আর্যা-কে। তাঁর বেশ কিছু মুভমেন্ট, চাহনি আলাদা মুহূর্ত গড়ে দিয়েছে। তাঁকে বাংলা মঞ্চে 'নতুন' মনে হয়নি। আদিবাসী যুবক হিসেবে শ্রমণ 'বুকঝিম'-এর পর আরও একবার চমকে দিলেন। এখানে তাঁর গানের গলাটিও ব্যবহার করা গিয়েছে চমৎকার। মনে রাখতে হবে গান ছাড়া এ নাটকের মুডই প্রতিষ্ঠা করা যেত না। বাকি তিন অভিনেতাও অসম্ভব ভালো বাঁধুনি দিয়ে রেখেছেন নাটকে।
চরিত্রগুলো সব কাল্পনিক নাকি বাস্তবের
মূল কাহিনি: পরশুরাম
পরিচালনা: অনমিত্র খান
দল: বিডন স্ট্রিট শুভম
অভিনয়: অর্পিতা, অস্মিতা, সুপর্ণা, বিবেক, সৌরভ, স্বরগীতি, আদিত্য প্রমুখ
দুই হরিহর আত্মা বন্ধু মহেশ এবং হরিনাথ। তাঁরা একই কলেজে অঙ্ক আর দর্শন-এর অধ্যাপক ছিলেন। যদিও তাঁরা অত্যন্ত বন্ধু তবুও তাঁদের মাঝেমধ্যেই বিবাদেও জড়িয়ে পড়তে দেখেছেন মানুষ। হওয়ার সঙ্গত কারণও রয়েছে। এক বন্ধু নাস্তিক, তো অন্যজন ঘোর ঈশ্বর ও আত্মা-য় বিশ্বাসী। একজন সুপারন্যাচরালের হয়ে সওয়াল করেন, তো অন্যজন সেইসব যুক্তি খণ্ডন করতে থাকেন। এভাবেই চলতে থাকে। একসময়ে এক বন্ধু অপরকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন, ভূত চতুর্দশীর রাতে ভূত চাক্ষুস করাবেনই। তারপর.. কি ঘটল? সত্যিই কি ভূতের মুখোমুখি পড়া গেল? কি এমন ঘটল সেদিনের রাতে যে শেষটায় দুই বন্ধুর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল? কিন্তু কিছু অস্পষ্ট ফিগার তো দৃশ্যমান হল আঁধারে, কারা তারা? ফিসফিসটাই বা কারা করল? সেটা মঞ্চে দেখাই ভাল।
একটা সিরিও কমিক সুপারন্যাচরাল থ্রিলার এর আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে নাটক। বিভিন্ন দৃশ্যে এই মেজাজ ধরে রাখাটাই ছিল আসল চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া দুটো বন্ধুর সম্পর্কের ভালো দিকগুলোর মাঝে অতিবাস্তব, পরাবাস্তবের উপস্থিতি কেমন করে আলাদা দেওয়াল তুলে দিচ্ছে সেটাও উপজীব্য। বিশ্বাস নাকি অবিশ্বাস সেই চিরন্তন এক আবর্তের মাঝে ঘুরপাক খেয়েছে নাটক। দৃশ্যগুলিকে সচেতনভাবেই আনপ্রেডিকটেবল করে রাখা হয়েছে। পরিচালকের কৃতিত্ব তো এতে আছেই, তা ছাড়াও কল্লোল লাহিড়ির স্ক্রিপ্ট রাইটিং-এর ওয়ার্কশপ এতে আলাদা প্রভাব রেখেছে বলে জানা গিয়েছে। নাটকের দুটো অর্ধের সূক্ষ্ম যোগসূত্রগুলো খেয়াল করার মতো। দুটো বন্ধুর গভীর সম্পর্ক আর তা কোথায় যেন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাচ্ছে অশরীরীর থাকা না থাকার দ্বন্দ্বে।
পরশুরামের গল্পের যে একটা নিজস্ব ফ্লেভার আছে তাকে অক্ষুণ্ণ রেখে তাকে মঞ্চায়ন করার মধ্যে একটা অন্য রকম ব্যাপার থেকেই যায়। প্রচুর নতুন অভিনেতা ও অভিনেত্রী নিয়ে কাজটি করেছে বিডন স্ট্রিট শুভম। এই দলের কর্ণধার আশিস খাঁ-র কাজের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা জানেন, বরাবরই তিনি নতুনদের নিয়ে কাজ করার চ্যালেঞ্জে নিজেকে আগুয়ান করেছেন। তাঁর সেই ধারা অনমিত্রর কাজের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। একটা অন্য রকম প্রয়াস বলাই যেতে পারে।
দশে প্রাচ্য, উৎসবে দুই বাংলার নাটক
এ বছর দশে পা দিল আলিপুর প্রাচ্য নাট্যদল। আর তাদের উৎসব পড়ল পাঁচ বছরে । ‘পূবের নাট্যগাথা’ শীর্ষক এবারের উৎসবটি আয়োজিত হয়েছে সল্টলেকের পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পূর্বাশা অডিটোরিয়ামে। উৎসব চলবে আগামী ২২ থেকে ২৮ জুন। এপার বাংলার পাশাপাশি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি দলের নাটক দেখার সুযোগ মিলবে উৎসবে।
সাত দিনের উৎসব শুরু হবে নয়ে নাটুয়া গোষ্ঠীর ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ নাটক দিয়ে, যার রচনা, নির্দেশনায় গৌতম হালদার। পরদিন কল্যাণী নাট্যচর্চাকেন্দ্রের ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’, নির্দেশনায় কিশোর সেনগুপ্ত। তৃতীয় দিনে দেখা যাবে প্রাচ্য-র নতুন নাটক ‘লাল শালু’। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের উপন্যাস থেকে নাট্যরূপ করেছেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। নির্দেশনায় অবন্তী চক্রবর্তী। চমক, নাটকের আলোয় চিত্রগ্রাহক শীর্ষ রায়। কেন্দ্রীয় চরিত্রে প্রাচ্য-র প্রাণপুরুষ বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় (পাশের ছবি)।
পরদিন সিরাজগঞ্জের নাট্যলোক গোষ্ঠীর প্রযোজনা ‘রূপসুন্দরী’, পরিচালনায় অনিলকুমার সাহা। দেখা যাবে ঢাকার শব্দনাট্যচর্চাকেন্দ্রের ‘চম্পাবতী’, নির্দেশনায় খোরশেদুল আলম। আছে যশোরের বিবর্তন গোষ্ঠীর ‘মাতব্রিং’ ,যার পরিচালনায় ইউসূফ হাসান অর্ক। শেষ দিনে ‘হেলেন কেলার’ মঞ্চস্থ করবে ঢাকার একটি নাট্যদল। প্রাচ্য-প্রধান বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় আশা প্রকাশ করেন, অন্য বারের মতো এবারও উৎসব সফল করবেন নাট্যমোদী মানুষ।
ঐতিহাসিক নাটকে থ্রিলারের মেজাজ
সেন রাজবংশের রাজা লক্ষ্মণ সেনের পতন আসন্ন, রাজ্য দখল নিতে হায়নার মতো বসে হিংস্র বখতিয়ার খিলজি। এমনই এক সময়কালে বয়ে গিয়েছে নাটকটি।
সেন শাসনের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যের ফাঁক গলেই তো এই বিদেশি আগ্রাসন। যার ফলে বাংলায় ঘটে গিয়েছিল দেশজ ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তন। অর্থাৎ এক দিক দিয়ে দেখলে এ নাটক এগারশো-বারশো শতকের বঙ্গভূমির এক অধ্যায়। মানে ঐতিহাসিক নাটক। আবার বিদেশি আগ্রাসনে দেশি সংস্কৃতির পতন, রাজ্যে অনাচারের মধ্যে কোথাও যেন এই সময়টাও ধরা পড়ছে।
একদিকে স্বজাতির স্খলন ঘটছে, পাশেই চলছে বিজাতির আগ্রাসন। রাষ্ট্রের নানা ভ্রান্তি আর বিচ্যুতিগুলো না চাইতেও সামনে চলে আসছে। এই ট্রানজিশন্যাল সময়টাতে দেশের মধ্যে নানা অনাচার চলতে থাকে। এই যে সব অন্ধকার অলিগলি তাতেই ঘুরে বেড়িয়েছে নাটকের কাহিনি। রাজাদের মহত্ব প্রচার নয়, সিংহাসনের ছায়ায় থাকা অন্ধকারে মশাল জ্বেলে অনুসন্ধানে নেমেছেন প্রবীণ নাট্যকার চন্দন সেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কিন্তু যেন হাল সময়ের কোনও পলিটিক্যাল থ্রিলারের মেজাজ। যিনি ধর্ষণ করেছেন তিনি রাজার আত্মীয়, তাই তাঁর শাস্তি পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। উল্টে বেঁধে আনা হয়েছে ধর্ষিতাকে। বন্দি করা হয়েছে ধর্ষিতার পিতাকেও। এ সময়ের এক-আধটা ধর্ষণের ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে, তাই তো? সেই কাজটাই অতি সূক্ষতার সঙ্গে করতে চেয়েছেন নাট্যকার। আর উপস্থাপনটাও জমিয়ে দিয়েছেন তপনজ্যোতি। কস্টিউম, আলো, সেট-এ সময়টা ভারি সুন্দর উপলব্ধি করা গিয়েছে।
মাধবী-র ধর্ষণ ঘটেছে, সেটা রাজা লক্ষ্মণ সেনকে বলতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে। কারণ তিনি তো অমাত্য হলায়ূধ মিত্রর বুদ্ধিতেই চলেন। আর হলায়ূধ ক্ষমতাকে ধরে রাখতে যে কোনও নীচতায় নামতেই পিছপা নন। কিন্তু অন্যায়ের এই ঘানি কি কেবল একমুখী? তা বোধহয় নয়। চাকা একসময়ে উল্টো দিকেও ঘোরে। আর যাদের পিষে যাওয়া হয়েছিল তারাই আড়ালে একজোট হয়। কিন্তু তাতেও কি রক্ষা হয়? তাদের ঘাড়ে পা দিয়ে বিদেশি শক্তিই তো এসে পড়ে। রাষ্ট্র কেমন করে অবৈধ ক্ষমতার জন্ম দেয়, ক্ষমতা কেমন করে পাপের দোসর হয়, পাপ কেমন করে ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে এই সব নাটকে দেখতে বেশ লাগে। হলায়ূধ মিশ্র-র ভূমিকায় তপনজ্যোতি আর খিলজি হিসেবে সঞ্জীবের হিংস্রতা, মাধবী আর শশীকলা হিসেবে সেঁজুতি আর সুকৃতীর রং পরিবর্তন মনে থাকে। জয়দেব-পদ্মাবতী, শান্ত কবি দম্পতি হিসেবে ভালো লেগেছে রাজীব-রায়তীকে। কিন্তু গ্রামবাসীরা নৌকায় যে রকম ঝলমলে পোশাকে নাচ-গান করেছেন, সেটা একটু বিসদৃশ লেগেছে। তাঁরা একটু ধূসর পোশাকে সামনে এলেই বোধহয় ভালো লাগত।
তবে ইতিহাসের যে পুনরাবৃত্তি হয় তা তো বহুবার প্রমাণিত। তাই সেই সময়ের সঙ্গে এই সময়ের সূক্ষ্ম মিলগুলো নাটকে দেখার পর ভাবনা হয় বইকি!
নাটক: চতুষ্পাপ
রচনা: চন্দন সেন
নির্দেশনা: তপনজ্যোতি
দল: রঙ্গপট
অভিনয়: তপনজ্যোতি, বিপ্লাণু, সঞ্জীব, সেঁজুতি, রায়তী, রাজীব, সুকৃতি
বিপন্ন দুই নাট্যকর্মীকে বাঁচাতে লড়ছে বাংলার থিয়েটার, একসন্ধে নাটক দেখুন প্লিজ!
সম্প্রতি 'নিভা আর্টসে'র উদ্যোগে তপন থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হল পাঁচ দিনের নাট্যোৎসব। এই পাঁচ দিনে ( ১৬ থেকে ২০ জুন) যে কটি দল অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকে তাঁদের টিকিট বিক্রির টাকা তুলে দিয়েছেন সতীশের চিকিৎসার জন্য। এমনকী যাঁরা সেট করেন, লাইটের দায়িত্ব সামলান, মেকআপ করেন তাঁরাও কেউ কোনও পারিশ্রমিক নেননি। নিভা আর্টসের কর্ণধার সমর মিত্র এই কদিন হলের জন্য কোনও হল ভাড়া নেন নি। শনি এবং রবিবার তিনটি করে শো হয়েছে। 'গোরুর গাড়ির হেডলাইট' থেকে শুরু করে 'চন্দ্রগুপ্ত', 'বুকঝিম এক ভালোবাসা', 'শেকল ছাড়া হাতের খোঁজে' ইত্যাদি নাটক তো ছিলই। এছাড়াও আরও বহু দল আবেদন করেছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে তাঁদের আর স্লট দেওয়া যায়নি বলে জানালেন 'বীরভূম রেপার্টরি থিয়েটারের' কর্মী গম্ভীরা ভট্টাচার্য। তবে সময়ের অভাবে হয়তো খুব বেশি প্রচার করা যায় নি। আরও বেশি মানুষের সহযোগিতা পেলে ভালো লাগত বলে জানালেন গম্ভীরা ভট্টাচার্য। তিনি আরও জানান, হলের বাইরে একটি বক্স রাখা ছিল। হল থেকে বেরোনোর পথে অনেকেই সেখানে সাধ্যমত অর্থ সাহায্য করেছেন।
গত ১৯শে জুন ,নৈহাটি ঐকতানে অসুস্থ নাট্যকর্মীদের সাহায্যার্থে অ্যাস্থেটিকস'এর উদ্যোগে এপার বাংলা-ওপার বাংলার শিল্পীদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত হল ,'বাঙালিয়ানার উদযাপন'। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রাহুল রাজ , নাটক 'কপাল' নিয়ে। এছাড়াও মঞ্চস্থ হয় 'এথিনিয়া' এবং 'উজাগর' নাটক দুটি। এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নৈহাটি পৌরসভার পৌরপ্রধান অশোক চট্টোপাধ্যায়, এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন ব্যারাকপুর মহকুমার তথ্য আধিকারিক শ্রী পল্লব পাল।আয়োজক সংস্থার পক্ষ থেকে নাট্যকর্মী শমিত জানান,"সকলের ভালোবাসা- আশীর্বাদ-দোয়া না পেলে এই অনুষ্ঠান সফল হতোনা,বিশেষ করে নৈহাটি পৌরসভা আমাদের ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। বিনামূল্যে হল দিয়েছেন। ভাবতে ভালো লাগছে যে,এই স্বার্থপর সময়ে দুই দেশের শিল্পীরা এক হয়েছেন অসুস্থ নাট্যকর্মীদের পাশে দাঁড়াবেন বলে...সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষরা প্রেক্ষাগৃহ ভরিয়ে দিয়েছেন...আমরা সকলের কাছে কৃতজ্ঞ..ভবিষ্যতে এরকম আরোও ব্যতিক্রমী আয়োজনের মধ্য দিয়েই বাংলা থিয়েটারের পাশে থাকতে চাই আমরা.."
আগামী ২৭ জুন অসুস্থ নাট্যকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে মিনার্ভা রেপার্টরিতে 'কোজাগরীর' শো করছেন 'বেলঘরিয়া অভিমুখ'।
আবার মঞ্চে ফিরুক সতীশ দা, গণপতি দা- এই আশা নিয়েই বুক বেঁধেছেন নাট্যকর্মীরা।
শহরে হুল ফোটাবে ৫৫ লোক নাট্যকর্মীর লড়াই!
এই প্রযোজনায় ৫৫ জন লোকশিল্পী যুক্ত রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৩০জন সাঁওতালি নাচ-গানের সঙ্গে যুক্ত। বাকিরা রায়বেঁশে শিল্পী। দেবক নামের একটি আদিবাসী গ্রামে প্রকৃতির মাঝে শিল্পীদের নিয়ে চলেছে মহড়া। ৩০ জুন, হুল দিবসে রাজ্য সরকারের আয়োজনে বারাসত তিতুমীর ভবেনে প্রথম অভিনয় হবের এই নাট্যের। এই প্রথম লোকপ্রসার শিল্পীদের নিয়ে এরকম একটি প্রযোজনা হতে চলেছে। যেখানে রীনা সর্দার, সনাতন সর্দার প্রথম বার শহরের নাট্য কর্মীদের সঙ্গে কাজ করলেন। শমিত জানালেন, "ব্যারাকপুর মহকুমা তথ্য আধিকারিক পল্লব পালের সাহায্য না পেলে,এই প্রযোজনা হতো না..উনিই প্রাথমিক উদ্যোগটা নিয়েছিলেন''।
জল-জঙ্গল-পাহাড়ের ওপর আদিবাসীদের অধিকারের জন্যই একসময় সিধু-কানু'র 'হুলের' ডাক দিয়েছিলেন..আজও দেশের নানা প্রান্থে এই লড়াই চলছে,তাই আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই নাটক খুব জরুরি।
পল্লবীর 'ওহ ছোকরি' রূপে মঞ্চে টিভির ইন্দ্রাণী
মাত্র তিন পাতার একটা গল্প লিখেছিলেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, ওরফে বনফুল। নাম ‘ছুঁড়িটা’। ভারত স্বাধীন হওয়ার বছরের আশেপাশে। আর সেটুকুতেই চমৎকারভাবে উঠে এসেছিল রাজনীতিকের চরিত্রের অন্ধকার দিকটা: রাজনীতিতে উচ্চ ক্ষমতার লোভে বিয়ে-না-হওয়া স্ত্রী এবং বিবাহবহির্ভূত কন্যাকে পরিত্যাগ করে চলে যান যিনি। অনেক পরে মেয়েটির ঠাঁই হয় রেলস্টেশনে। সে অপেক্ষা করে একদিন বাবার সঙ্গে দেখা হবে। যেদিন দূর থেকে দেখতে পায়, বাবা সমর্থকদের ভিড়ে হারিয়ে যান। বাবা বক্তৃতায় সকলকে ‘চরিত্রবান’ হওয়ার পরামর্শ দেন!
সেই গল্প অবলম্বনেই ১৯৯৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘ওহ ছোকড়ি’। শুভঙ্কর ঘোষ পরিচালিত সেই ছবি তিনটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল সেবার। ছোকরির চরিত্রে পল্লবী যোশী পান স্পেশ্যাল জুরি অ্যাওয়ার্ড। আর এরকম কাহিনিই এবার নতুন আঙ্গিকে, নতুন সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আসতে চলেছে মঞ্চে। থ্যাটার কোলকেতা নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায়, এডওয়ার্ড কবীরের সামগ্রিক উদ্যোগে মঞ্চস্থ হতে চলেছে ‘ছুকড়ি’। উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় রচিত নাটকটি পরিচালনা করছেন দেবরঞ্জন নাগ।
‘ছুকড়ি’ ওরফে অপ্সরীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন ইন্দ্রাণী সরকার। বাংলার ধারাবাহিক-প্রিয় দর্শক তাঁকে বিলক্ষণ চেনেন ‘জড়োয়ার ঝুমকো’-র সতী কিংবা ‘ভজগোবিন্দ’-র খেঁদি হিসেবে। ধারাবাহিক ছেড়ে নাটকে চলে আসার কারণ? ইন্দ্রাণী বলছেন, ‘জানি বিপুল সংখ্যক মানুষ আমাকে ধারাবাহিকের কারণেই চেনেন। কিন্তু আমি তো থিয়েটারের বাড়ির মেয়ে। আমার বাবা সুনীল সরকার বহুরূপীতে নিয়মিত কাজ করেছেন শম্ভু মিত্রের সময়ে। বাবাকে দেখেই আমার ছোট থেকে মঞ্চের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। আমি দেবাশিস মজুমদারের পরিচালনায় শূদ্রক নাট্যগোষ্ঠীর ‘রাঙামাটি’, ‘পর্যবর্ত’, ‘দহনান্ত’ নাটকে কাজ করেছি।’
তাহলে ধারাবাহিকে কাজ করে যাওয়া? ইন্দ্রাণীর ব্যাখ্যা, ‘আমার বাবাও কিন্তু নাটক করার পাশাপাশি ধারাবাহিকে অভিনয় করতেন নিয়মিত। দূরদর্শনে ‘কলকাতা কলকাতা’ ধারাবাহিকে তাঁর অভিনীত নিবারণ ঢোল চরিত্র মারাত্মক জনপ্রিয় হয়েছিল। সত্যজিৎ রায় তাঁকে ‘সোনার কেল্লা’-য় নিয়েছিলেন মুকুলের বাবার চরিত্রে, ‘হীরক রাজার দেশে’-তে। অর্থাৎ ধারাবাহিকে, ছবিতে কাজ করার জন্য যে মঞ্চ থেকে সরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই সেটাও বাবার থেকেই শেখা।’
‘ওহ ছোকরি’ দেখেছেন? ইন্দ্রাণী বলেন, ‘হ্যাঁ, দেখেছি। পল্লবী খুব ভালো অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু ছবির সঙ্গে নাটকের তো গঠনগত, প্রকাশগত তফাৎ থাকে। তাছাড়া উজ্জ্বলদার লেখায় অনেক নতুন চরিত্র আছে। অনেক নতুন দিক উঠে এসেছে। সেটা তাঁর মৌলিক সৃষ্টি। তাছাড়া ‘ওহ ছোকরি’-র পর আরও অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। এখনকার সময়ে বনফুলের গল্পটা আরও একবার বলা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।’
নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি সিনেমাটা দেখিনি। ইচ্ছাকৃতভাবেই, প্রভাবমুক্ত থাকার জন্য। বনফুলের গল্পটা যে রকমভাবে দেখেছি, তেমনভাবেই লিখেছি।’ নাটকের সৃষ্টি নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘গল্পটা থেকে নাটক লিখতে গিয়ে গল্পের মূল কাঠামোটা ব্যবহার করেছি। কিন্তু ঘটনাগুলোকে সমসাময়িক করেছি। কোনও নির্দিষ্ট পার্টি বা রাজনৈতিক ব্যক্তির উল্লেখ করা হয়নি। একজন রাজনীতিকের জীবনের অন্ধকার দিকটা ধরা হয়েছে। নাটকটায় টাইম অ্যান্ড স্পেসটা অন্যভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রেজেন্ট আর ফ্ল্যাশব্যাক একসঙ্গে চলছে। একদিকে স্টেশনে মেয়েটার জীবন দেখানো হচ্ছে। পাশেই আবার সেই রাজনীতিবিদ বাবার জীবন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কখনও মেয়েটা ফিরে যাচ্ছে ছোটবেলায়, মায়ের কাছে। অনেকগুলো সময়, মুহূর্ত একই সময়ে মঞ্চে আনাগোনা করছে।’
নাটক পরিচালনা করছেন দেবরঞ্জন নাগ, যাঁকে নিয়মিত পর্দায় ক্যারেকটার রোলে পাওয়া যায়। তবে তাঁর শুরুটা ছিল মঞ্চ থেকেই। দেবরঞ্জন জানাচ্ছেন, ‘আমি নাটক শিখেছি রমাপ্রসাদ বণিকের কাছে। ওঁর সঙ্গে ‘টেম্পেস্ট’, ‘দহনশীল’ পর্যন্ত শেষ কাজ করেছি। তখন আমি, চন্দন সেন, খরাজ মুখোপাধ্যায়, লাবণী সরকার সবাই একসঙ্গে কাজ করতাম।’
তারপর কি নাটকে ইতি? হেসে দেবরঞ্জন বলেন, ‘না না। তারপরেও দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ফ্যাতাড়ু’তে ডিএস-এর রোল করেছি। অঞ্জন দত্ত-র ‘গ্যালিলিও’-তেও অভিনয় করেছি। দৃশ্যপট গ্রুপের ‘চক্র’ নাটকে আমি আর কাঞ্চন মল্লিক অভিনয় করেছি।’
এই নাটক পরিচালনার ব্যাপারে জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘গল্পটাকে এই সময়ে আনা হয়েছে। ঘটনাস্থলকে অনেক বিস্তৃত করা হয়েছে। মেয়েটির যাত্রা কলকাতা থেকে শুরু হয়। ক্রমে সে রানিগঞ্জ, বিহার হয়ে ঝাড়খণ্ডের বড়াজামদা স্টেশনে আশ্রয় নেয়। মা তাকে পনেরো বছর বয়সে এক বাবুর কাছে বিক্রি করে দেয়। আরও নানা হাত ঘুরে সে বিহারে শরীর-প্রদর্শনকারী নাচের দলে জোটে। একসময়ে স্টেশনে আশ্রয় নেয়।’
ছুকরির রাজনীতিক বাবার ভূমিকায় প্রেমাঞ্জন দাশগুপ্ত। মায়ের রোলে সুপর্ণা দে। যে বাবুর কাছে ছুকরি ওরফে অপ্সরীকে বিক্রি করা হয় সেই রতনলাল চৌধুরীর ভূমিকায় সুদীপ মুখোপাধ্যায়। অপর বাবু তপনকুমার সাহা। রাজনীতিক দিল্লিতে যে মহিলাকে বিয়ে করেন ক্ষমতা অর্জনের জন্য সেই রেশমি সিংয়ের রোলে জৈত্রী চৌধুরী। আর কনফিডেন্সিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের রোলে দেবরঞ্জন নাগ। সেট নীল-কৌশিক-এর। আবহে ‘ভূমি’-খ্যাত সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়। আলোয় কল্যাণ।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে বনফুলের গল্প কতখানি তাৎপর্য বহন করল তা দেখতে অপেক্ষা সামান্যই। প্রথমবার ‘ছুঁড়িটা’ দেখতে পাওয়া যাবে ২১ জুলাই সন্ধ্যায়, তপন থিয়েটারে।
ভূতের খোঁজে আধুনিক ব্যোমকেশ
ইন্দ্রনীল শুক্লা
এটা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই গল্পটাই। মানে একটা খুন। একটা বাড়িতে হঠাৎ ভূতের উপদ্রব। পুলিশের হস্তক্ষেপ। শেষটায় বিভিন্ন সূত্র মিলিয়ে খুনি এবং খুনের কারণ খুঁজে বের করলেন ব্যোমকেশ বক্সী। এর ভিত্তিতেই নাটক প্রস্তুত করেছে বালি প্রভাত নাট্য সংস্থা। ব্যোমকেশ ও অজিত হিসেবে দীপ্যমান ও ইনু তো বটেই গোটা নাটকটা জুড়েই একটা ইয়ং ব্রিগেড কাজ করেছে। তাই যদি হয়, তা হলে ব্যোমকেশও নিশ্চয়ই সেই আগের চেহারায় থাকবেন না, সময়কালটাও হয়তো বদলে যাবে, পোশাক-পরিচ্ছদেও পরিবর্তন ঘটবে। কাহিনিও কি বদলাচ্ছে? দেখে নেওয়া যাক এখানে কি ঘটছে?
উমাপতি সেন নামের এক হীরে-জহরত ব্যবসায়ী হঠাৎ করেই নিজের বাড়িতে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর হাতে খুন হন। তদন্তের দায়িত্ব পান পুলিশ অফিসার পিটার ডি’সুজা। তিনি শহরের ভিতর বহু মানুষকে সন্দেহ করলেও দোষীকে চিহ্নিত করতে পারেন না। তিন মাস কাটে। এরই মধ্যে ওই বাড়িতে আসে নতুন ভাড়াটে কৈলাস মল্লিক। তাঁর আমেনর পর থেকেই বাড়িতে ঘটতে থাকে অদ্ভুত কিছু ঘটনা। তিনি জানলার বাইরে এক অতিমানবিক জীবকে দেখতে পান। ভৌতিক ঘটনা ঘটতে থাকে। এদিকে মুঙ্গের শহরের ভিতরে বরোদা নামের এক ভদ্রলোক থাকেন, যিনি ভূত নিয়ে নানা গবেষণা করেন। তার মাধ্যমে ঘটনাগুলো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। রটে যায়, উমাপতি সেনের ভূত ফিরে এসেছে তার হত্যার প্রতিশোধ নিতে। আর এই অবস্থাতেই পিটার বাল্যবন্ধু ব্যোমকেশকে কলকাতা থেকে ডেকে পাঠায়। ব্যোমকেশ তদন্তের ভার নেয়। আর কিছু বলা ঠিক হবে না।
এখন কথা হল, বর্তমান আলোচনায় গল্পটা বলা হোক বা না হোক, এটা অতি পরিচিত গল্প, তাই আততায়ী কে, তা তো সকলেই জানেন। কে আসলে কোন গুপ্ত সাজে রয়েছেন, তা পাঠকের জানা। কিন্তু এই জায়গাটাতেই নাট্য পরিচালক খানিক স্বাধীনতা নিয়েছেন। স্কেলিটন স্ট্রাকচার এক রেখে আততায়ী, ক্লাবের সদস্য ইত্যাদি ইত্যাদি চরিত্রে বদল-বদল ঘটানো হয়েছে। তাতে সব কিছু জেনেই তদন্ত দেখতে বসছি এমন ভেবে নেওয়ার অবকাশ থাকছে না। এ নাটকে ব্যোমকেশকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। ঠিক আজকের সময়ে থাকলে ব্যোমকেশ কেমন হতেন সেটা মঞ্চায়নের চেষ্টা হয়েছে। সে চেষ্টা সফল না বিফল তা বিচারের ভার অবশ্যই দর্শকের। কারণ, ব্যোমকেশ জামা-প্যান্ট পরে, হাতে টেবিল-টেনিস ব্যাট-বল নিয়ে খেলতে খেলতে রহস্যের কথা ভাবছেন, এটা কেমন লাগছে দেখতে, তা খুব আপেক্ষিক প্রশ্ন। কারও কারও ভালোও লাগতে পারে!
তবে গোটা নাটকজুড়ে মারাত্মক একটা ভয়ের বাতাবরণ গড়ে দেওয়া গিয়েছে সাফল্যের সঙ্গে। শ্রমণ (পিটার), প্রসেনজিৎ (মদনলাল), সুমিতের (অধিরাজ) মতো ইয়ং ট্যালেন্টেড অভিনেতারা চেষ্টা করেছেন নাটকের উত্তেজনা, টেম্পো ধরে রাখতে। এতদিন নানা নাটকে মূলত কিছু ডান্স সিক্যোয়েন্সে কাজ করলেও এখানে খানিক অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে কাজে লাগিয়েছেন আম্রপালি (বৃষ্টি)। স্নব এক উকিল-পত্নীর ছোট্ট রোলে মউলিও (নিরূপমা)ভালো। মোটের উপর তরুণ অভিনেতারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাল প্রোডাকশনের চেষ্টা করছেন, সেটা চোখে পড়েছে। আলাদা করে আলো আর সেট-এর কথা বলা দরকার। কারণ, সেই কারণেই ক্লাব সদস্যদের কমিক সিক্যোয়েন্সের পাশাপাশি জানলা দিয়ে ভূতের উঁকি দেওয়া, দোতলায় লোকজনের থমথমে আনাগোনা, এই সব কিন্তু বেশ টানটান হয়ে দেখতে হয়।
নাটক: ভূতাণ্বেষী
রচনা, নির্দেশনা: ইনু চক্রবর্তী
দল: বালি প্রভাত নাট্য সংস্থা
অভিনয়: দীপ্যমান, ইনু, সুমিত, শ্রমণ, আম্রপালি, প্রসেনজিৎ, মউলি প্রমুখ
এক সন্ধে থাক হিপোক্রিটস আর সারাংশের জন্য!
এই দুটি নাটকের মিউজিকও বেশ অভিনব। একটি নাটকে মহীনের 'আকাশে ছড়ানো' গানটি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও সারাংশের নিবেদনে থাকছে 'শেক্সপিয়র ফর সেল'।
'সারাংশ' এবং 'হিপোক্রিটস' দুটি দলেই পড়ুয়ারা দলে ভারী। এছাড়াও বেশকিছু চাকুরীজিবিও রয়েছেন। এই মুহূর্তে তাঁরা কাজ করছেন বেশ কিছু মৌলিক নাটক নিয়ে।
আপাতত, অনুরোধ একটাই. রবিবার সন্ধেটা একটু অন্যকরম কাটান ভিন্ন স্বাদের তিনটি নাটকের সঙ্গে।
কারণ ‘অপবিত্র’, মঞ্চে ফিরে আসছেন ট্রায়ো
নাট্যআননের ‘সিজার’ নাটকে এমনটা ঘটেছিল। একসঙ্গে মঞ্চে পাওয়া গিয়েছিল চন্দন সেন, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় আর সব্যসাচী চক্রবর্তীকে। পাওয়া গিয়েছিল কিছুদিন আগে জ্যোতিষ্মান চট্টোপাধ্যায় রচিত নাটক ‘সাত ফাঁকে বাঁধা’-র ক্ষেত্রেও। তাতে তো এই তিন জনের সঙ্গে ছিলেন রজতাভ দত্ত-ও। কিন্তু তা মঞ্চস্থ হয়েছিল এনএবিসি-র উৎসবে। তাই প্রবাসী বাঙালির বাইরে সেই নাটক রাজ্যের মানুষ উপভোগ করতে পারেননি। আরও একবার ঘটতে চলেছে ব্যাপারটা। জেরেমি লরেন্সের ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’ নাটক অবলম্বনে ‘অপবিত্র’ মঞ্চস্থ করতে চলেছে নাট্যআনন। মূল নাটক থেকে অনুবাদ করেছেন চন্দন সেন, পরিচালনাও তাঁরই।
উল্লেখ করা দরকার, ১৯৬০ সালে লেখা লরেন্সের সেই নাটকের প্লটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সত্য ঘটনা। ১৯২৫ সালে উত্তর আমেরিকায় এক স্কুলশিক্ষক ছাত্রদের ক্লাসে ডারউইনের তত্ত্ব পড়ান। আর এই বিবর্তন তত্ত্ব পড়ানোর কারণেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। চোর, ডাকাত, রাষ্ট্রদ্রোহীর বাইরে এই রকম কোনও কারণেও যে একজন মাস্টারমশাই গ্রেপ্তার হতে পারেন তা সাধারণ মানুষের ছিল প্রায় অজানা। শিক্ষক বারট্রাম কেটস-এর হয়ে লড়তে আসেন উকিল ডিফেন্স অ্যাটর্নি হেনরি ড্রামন্ড। খবর প্রকাশ করতে তৎপর হয়ে এগিয়ে আসেন সাংবাদিক ই কে হর্নবেক। আবার শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে লড়েন ম্যাথউ ব্র্যাডি। নিন্দায় মুখর হন পাদ্রী ব্রাউন। উকিল ড্রামন্ডের ভূমিকায় সব্যসাচী চক্রবর্তী। সাংবাদিক হর্নবেক হিসেবে মঞ্চে চন্দন সেন।
নাটকটা কি এদেশের মতো করে নেওয়া হয়েছে? চন্দন বলেন, ‘একেবারেই না। একদম এক চরিত্র, এক গল্পই রাখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে শুধু মঞ্চ নয়, হলিউডে পর্যন্ত আলাদা আলাদা সময়ে এ নাটক ভিত্তি করে তিনবার সিনেমা বানানো হয়েছে। অর্থাৎ, এই ঘটনার তাৎপর্য ওদেশেও কোথাও রয়ে গিয়েছে। মানুষ এটা আমেরিকার নাটক হিসেবেই দেখুক, এর সঙ্গে আমাদের দেশের মিলটা কোথায় সেটা দেখতে দেখতে এমনিই বোঝা যাবে। তাছাড়া খুব সূক্ষ্মভাবে বানর সেনার কথা, পুরাণের কথাও রাখা আছে।’
চন্দন বলেন, ‘নাটকে ডিফেন্স লইয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলেন যে বিজ্ঞানের তত্ত্ব, সত্য পড়ানো হলে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন আইন কেন রাখা হয়েছে দেশে? এটা কিন্তু মারাত্মক প্রশ্ন।’
‘অপবিত্র’ জোটে তিন অভিনেতাকে দেখতে অপেক্ষা করাই যেতে পারে অতএব। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অ্যাকাডেমি প্রেক্ষাগৃহে প্রথমবার দেখতে পাওয়া যাবে নাটকটি।
‘হারবার্ট’ এবার চেকভের ত্রিগোরিন
বাড়ির একজনের হাতে মৃত্যু হল এক প্রিয় সারসের। আর সেই মৃত সারসের সঙ্গে নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে মিল খুঁজে পেলেন বাড়ির সদস্যরা। সারস নানা ব্যঞ্জনার প্রতীক হয়ে উঠল। হ্যাঁ, চেকভের সেই ‘সিগাল’ নাটকের কথাই হচ্ছে। তা এবার মঞ্চস্থ করতে চলেছে গণকৃষ্টি নাট্যগোষ্ঠী। নামকরণ ‘কিরীটীর ডায়েরি’। আর তার কেন্দ্রীয় চরিত্র মানে সেই লেখক ত্রিগোরিনের ভূমিকায় পাওয়া যাবে শুভাশিস ‘হারবার্ট’ মুখোপাধ্যায়কে। চেকভ অবলম্বনে স্ক্রিপ্ট রচনা করেছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। পরিচালনায় অমিতাভ দত্ত।
চরিত্রটিতে অভিনয় প্রসঙ্গে শুভাশিস বলেন, ‘আমি অনেক রকমের ক্যারেকটার রোল জীবনে করেছি এটা ঠিক, তবু সেই জায়গায় দাঁড়িয়েও বলছি, এমন একটা চরিত্র আগে কখনও করিনি। আসলে আমার রিহার্সাল করতে করতে বার বার যেটা মনে হয়েছে সেটা হল, এই নাটকটি নিঃসন্দেহে কঠিন নাটক। আর এই চরিত্রটা অত্যন্ত জটিল। আবার নাটকের একটা চরিত্রের সঙ্গে অন্য চরিত্রের সম্পর্কগুলোও জটিল। আর একটা ভয়ের ব্যাপারও রয়েছে, এই নাটক যখন প্রথমবার মঞ্চস্থ হয়েছিল, তখন ত্রিগোরিনের রোলে অভিনয় করেন স্বয়ং স্তানিস্লাভস্কি!’
শুভাশিসের কথার জের ধরেই মনে পড়ে যেতে পারে, এ নাটক বাংলা থিয়েটারে আগেও বেশ কয়েকবার প্রযোজিত হয়েছে। নান্দীকার করেছিল ‘হে সিন্ধুসারস’ নামে।
রমাপ্রসাদ বণিক করেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রূপান্তরে ‘পাখি’ নামে। পরিচালক অমিতাভ দত্ত বলেন, ‘আমাদের প্রযোজনাটি এই সময়কে মাথায় রেখে করা। চেকভ থেকে হয়তো একটু সরেও এসেছি আমরা। যেমন আমাদের নাটকে গান রয়েছে, চেকভে যা ভাবাও যায় না। তাছাড়া হয়তো চেকভের আরেকটি নাটক ‘চেরি অরচার্ড’-এর থিমের একটা হালকা ছোঁয়াও পেতে পারেন।’
দু’কথায় মূল নাটকটা মনে করে নেওয়া যেতে পারে। গ্রীষ্মের ছুটিতে ভাইয়ের বাড়িতে এসেছেন প্রবীণ অভিনেত্রী ইরিনা। তাঁর সঙ্গেই এসেছেন সাহিত্যিক ত্রিগোরিন। তাঁর প্রেমে পড়ে পাশের বাড়ির সদ্য যুবতী নীনা। কিন্তু তিনি সে প্রেম গ্রহণ করেন না। ক্রমে জটিলতা তৈরি হতে থাকে। এই ত্রিগোরিনের নাম এখানে কিরীটী, যে ভূমিকায় শুভাশিস। ইরিনা এখানে আনন্দী, যে রোলে সোমা দত্ত। নীনা এখানে জরি। তাঁর ভূমিকায় সঞ্জিতা। আর তার ব্যাপারে উৎসাহী ছেলেটির ভূমিকায় সপ্তর্ষি। ত্রিগোরিনের ভূমিকায় কেমন লাগল শুভাশিস মুখোপাধ্যায়কে তা দেখতে অপেক্ষা সামান্যই। নাটকটি আগামী ৯ অগস্ট প্রথমবার মঞ্চস্থ হবে অ্যাকাডেমি প্রেক্ষাগৃহে।
দু’য়ের ঘরেই দুলাল
ছবির কাজ, সিরিয়ালের কাজ ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে নিজের প্যাশন মঞ্চাভিনয়কে কখনওই ছেড়ে যাননি দুলাল লাহিড়ি। নাটক পরিচালনা করেছেন, অভিনয়ও করেছেন। আর এই বছর যাত্রা এবং নাটক অর্থাৎ মঞ্চের দু'টি ফর্মেই নানা রকম কাজ করতে চলেছেন দুলাল। পার্থপ্রতিম দেবের পরিচালনায় কাজ করবেন 'সম্পর্ক' নাটকে। নিজের দল যোজক-এ পুরনো নাটক 'আবিষ্কার'-এ অভিনয়ের পাশাপাশি 'দাদাঠাকুর' নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করবেন। আবার যাত্রাপালা 'সংসারের খেলাঘর'-এও কেন্দ্রীয় ভূমিকায় তিনি।
২০১৫ সালে উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের স্ক্রিপ্টে নিজের দলের জন্য 'দাদাঠাকুর' নাটকটি পরিচালনা করেন দুলাল। তখন কয়েকটি শোয়ে শরৎপন্ডিত অর্থাৎ দা-ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় করেন রজত গঙ্গোপাধ্যায়। সেই নাটকই এবার ডিজাইন, গান ইত্যাদিতে সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে ফের মঞ্চে আনছেন দুলাল। আর এবারের অন্যতম আকর্ষণ চরিত্রটিতে অভিনয় করবেন তিনি নিজেই। দুলাল বলেন, 'দাদাঠাকুরের জীবন এত বর্ণময় যে তাকে, সোয়া দু'ঘণ্টায় স্টেজে তুলে ধরা খুব কঠিন। তবু মেরুদন্ড সোজা রাখা বিরল ব্যক্তিত্বটিকে আজকের বাঙালির মধ্যে আরও ছড়িয়ে দেওয়াও খুব জরুরি। বেশ কয়েকটা গানও রাখা হয়েছে তাঁর।' যোজকের একাদশতম জন্মদিনে ১৮ আগস্ট অ্যাকাডেমিতে 'দাদাঠাকুর' দেখা যাবে। একই উপলক্ষ্যে 'আবিষ্কার' নাটকেও অভিনয় করবেন তিনি ১৬ আগস্ট, গিরিশ মঞ্চে।
বাঘাযতীন আলাপের 'সম্পর্ক' নাটকের তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গিয়েছে। পার্থপ্রতিম দেব পরিচালিত সে নাটকে রয়েছে তিনটি প্রজন্মের মধ্যে টানাপোড়েনের সম্পর্কের গল্প। দাদু, ছেলে আর নাতিকে ঘিরে একটা মার্ডার মিস্ট্রি। দাদুর ভূমিকায় দুলাল লাহিড়ি। ছেলে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়। আর নাতির রোলে পার্থপ্রতিমের পুত্র সাগরদ্বীপ দেব। নিজের মা কেমনভাবে মারা গিয়েছিলেন সে রহস্য উন্মোচন করতে উদ্যমী নাতি। তার সন্দেহ দাদুকে! আসলে কী আছে এই খুনের পিছনে, সেটা দেখতে হবে নাটকে। প্রথমবার নাটকটি দেখতে পাওয়া যাবে আগামী ২ অক্টোবর, জ্ঞান মঞ্চে।
মঞ্চের অপর তথা আদি ফর্ম যাত্রাতেও সমান উৎসাহী দুলাল। কনক ভট্টাচার্যের উদ্যোগে চৈতন্য অপেরার 'সংসারের খেলাঘর' পালাতেও অভিনয় করতে চলেছেন তিনি। যাত্রায় অভিনয় প্রসঙ্গে এই প্রবীণ মঞ্চশিল্পী বলেন, 'যাত্রায় আমি আগেও কাজ করেছি। আমার অভিনীত একাধিক পালা একশো রজনী পার করেছে। আমি যে এই বাংলায় কতখানি জনপ্রিয়, তা যাত্রায় অভিনয় না করলে জানতেই পারতাম না হয়তো। ভীষণ আনন্দ পাই যখন দেখি রাত জেগে, বাড়ি থেকে আনা চাটাই বিছিয়ে ধানক্ষেতের উপর মানুষ বসে দেখছেন। শীতে চাদর মুড়িয়ে মানুষ বসে আছেন, বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে মহিলা বসে আছেন। নাটকে বুঝতে পারি সাতশো-হাজার মানুষের সামনে অভিনয় করছি, আর পালার মাঠে দেখতে পাই হাজার হাজার মাথা। এর স্বাদই আলাদা!'
'সংসারের খেলাঘর'-এর পালাকার বাবলি ভট্টাচার্য, পরিচালনায় রুমা দাশগুপ্ত। পালায় দেখা যায়, কলকাতায় এক পরিবারে একটি ছেলে হঠাৎ খুব অসুস্থ। তাকে ডাক্তার দেখানো হলে তিনি বলেন, শহরের মারাত্মক পলিউশনের জন্য এই অসুস্থতা। সুস্থ হতে হলে প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে দূষণমুক্ত পরিবেশে থাকতে হবে। ফলে, গ্রামে পাঠানো হয় ছেলেটিকে। তাকে দেখাশোনা করতে শুরু করেন এক গ্রামবাসী। ছেলেটি কি সুস্থ হতে পারল? সেটাই উপজীব্য। এই গ্রামবাসী পালক-পিতার ভূমিকাতেই রয়েছেন দুলাল লাহিড়ি।
এই বিপুল মঞ্চকর্মের পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রবীণ অভিনেতা হেসে বলেন, 'আসলে মঞ্চের কাঠের গন্ধটার একটা নেশা আছে। একবার সে নেশা ধরে গেলে আর সারা জীবনে তার থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। আমার যে অবস্থা হয়েছে আর কী!'
ভাল লাগে ডনকে, তার স্বপ্নকে
'ম্যান অফ লা মানচা' অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে এ নাটক। তবে নাটকের মধ্যেই নাটক চলতে থাকে এখানে। একটা জায়গা থেকে নাটক শুরু হয়, ক্রমে দ্বিতীয় নাটকে ঢুকে পড়ে চরিত্ররা।
শুরুতে দেখা যায়, রাষ্ট্র ও ধর্মবিরোধী বক্তব্য রাখার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কবি তথা নামী নাট্যকর্মী শুভময় দত্তকে। তাকে এবং তার সহকারী সত্যজিৎ মিশ্রকে একটি কয়েদখানায় সমনের জন্য অপেক্ষা করতে বলে আদলত। সেখানে আছে নানা অপরাধী। তারা পুরনো অভ্যাসেই এই নতুন দু'জনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লুঠপাট করার জন্য। একজনের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটা থামে। পুরনো কয়েদিরাই এদের দু'জনের বিচারসভা বসায়। সেখানে গভর্ণররূপী বর্ষীয়ান কয়েদি বিচারক এবং অন্যান্য কয়েদিরা জুরি। এদিকে শুভময় চাইলেন ওই কয়েদখানাকেই মঞ্চের মতো সাজিয়ে কয়েদিদের দিয়েই নাটক করতে। তার মাধ্যমেই বিচারসভায় আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন। সম্মতি মেলে।
এরপরই আমরা নাটকের দ্বিতীয় লেয়ারে প্রবেশ করব। 'পাগলা নাইট' ডন কিহোতের গল্প নিয়ে নাটক শুরু করেন শুভময়। প্রথমটায় কয়েদিরা তাল মেলাতে পারে না। কিন্তু ক্রমে তারা মিশতে থাকে ডন আর তার সঙ্গী স্যাঞ্চো পানসার সঙ্গে। দু'জনের অভিযানে হাওয়া কলের সঙ্গে অসম লড়াই- সরাইখানাকে দুর্গ ভাবা-পরিচারিকার মধ্যে মহীয়সী নারীকে খুঁজে পাওয়া- নাপিতের কামাবার সরাকে পবিত্র স্বর্ণশিরস্ত্রাণ মনে করা- শত্রুর কাছে বার বার পরাজিত হয়েও জেতার ইচ্ছেটাকে জিইয়ে রাখা ইত্যাদি ঘটনা ছাপ ফেলে কয়েদিদের মনে। নেহাতই খেলার ছলে নাটক শুরু করলেও কয়েদির ক্রমেই বুঁদ হয়ে যায় তার মধ্যে। তাদের মনের চারপাশের লৌহকঠিন গরাদে চিড় ধরতে থাকে। আশার সঞ্চার হয়, এই গরাদ ভেঙে পড়বে। ক্রমে আবার শুভময় 'ডন' থেকে ফেরেন নিজের মধ্যে। বিচারকদের চোখ ভিজে যায়। শেষটায় কী হল তাঁর, মঞ্চে দেখাই ভাল।
নাটকে সবকিছু এলোমেলো করা মুহূর্ত রয়েছে। ধোঁয়া আর আলোয় বেশ কিছু মায়াবী মোমেন্ট তৈরি হয়। বাস্তব আর কল্পনা একটা সীমারেখায় যেন মিলে যায়। কয়েদি আর তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের মধ্যেও সেই আশার সঞ্চার ঘটতে থাকে যে অসময়ের মধ্যেও স্বপ্ন দেখতে চাওয়াটাকে তো বাঁচিয়ে রাখাই যায়। সেটুকুই তো এগিয়ে যেতে সাহস যোগায় আমাদের।
নিজেকে 'ডন' করে তুলতে অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন সুমন মুখোপাধ্যায়। অনেকখানি ওজন কমিয়ে পুরো ঝরঝরে তিনি। তাই অভিনয় তো বটেই, নেচে-গেয়ে মঞ্চ জুড়ে আক্ষরিক অর্থে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। প্রথম দিকের শো-গুলিতে স্যাঞ্চোর রোলে ভাল কাজ করেছেন সতীশ সাউ। দুর্ভাগ্যবশত তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর হাল ধরেছেন নাটকের পরিচালক সুজন মুখোপাধ্যায়। এমন একটি বিগ ক্যানভাস নাটক পরিচালনার পাশাপাশি তাতে অভিনয় করা সহজ ব্যাপার নয়। তবে এর আগেও 'ঘাসীরাম কোতয়াল'-এর মতো নাটকে তিনি পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। একটা মাত্র দৃশ্যে নিজের জাত চিনিয়ে দেন অরুণবাবু। উল্লেখ করতে হবে আলদনসা-র ভূমিকা নিবেদিতার কথাও। তাঁর এত চমৎকার স্টেজ প্রেজেন্স সাম্প্রতিককালে আর ঘটেনি। যেহেতু এ নাটকে অসংখ্য চরিত্র, তাই দলগত এফর্টটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নাটক শেষ হওয়ার পরও গান গুনগুন করতে পারেন দর্শক। সঙ্গীতায়োজনের কাজ ভারি সুন্দর সম্পন্ন করেছেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়।
অস্থির সময়ে একটুকরো আশার সঞ্চার করতেই পারে এ প্রযোজনা। নাটক, নাট্যকার বিদায় নেন। কিন্তু ডনের স্বপ্ন থেকে যায় সকলের মধ্যেই।
নাটক: ডন, তাকে ভালোলাগে
পরিমার্জনা, পরিচালনা: সজন মুখোপাধ্যায়
দল: চেতনা
অভিনয়: সুমন, সুজন ও নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়
রেটিং: সাড়ে তিন
নাট্যকর্মীদের আশ্রয় আরোগ্যর ডানা
রাত দশটা হবে তখন। খবরটা ছড়াল সোশ্যাল মিডিয়ায়---বাসন্তীর নাট্যকর্মী গণপতি নস্কর প্রবল অসুস্থ, বাইপাস সার্জারির জন্য রাতারাতি প্রয়োজন চার লক্ষ টাকা!
রেশ কাটল না, সকাল হতেই ফের একটা দুঃসংবাদ। এবারও সোশ্যাল মিডিয়াতেই--- ভালো নেই বর্ষীয়াণ শিল্পী সতীশ সাউ। ক্যান্সার ধরা পড়েছে তাঁর, অবিলম্বে চিকিৎসা শুরু না হলে ঝুঁকি বাড়বে বইকি।
খবরগুলো কানে আসার পর বসে থাকতে পারেননি ওঁরা পাঁচজন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভরসা করে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা শুরু তখনই। সাড়াও মিলল। শহরের আরও নানা নাট্যপ্রেমী, নাট্যকর্মী-শিল্পীদের সাহায্যে গণপতি নস্করের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হল প্রায় ৯৫ হাজার টাকা। সতীশবাবুকে ভর্তি করানো হল বাইপাসের ধারের এক হাসপাতালে।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হয়নি। দুই বর্ষীয়াণ প্রতিভার অসুস্থতা-অভাবই ভাবিয়ে তুলেছিল উত্তর কলকাতার পাঁচ বন্ধুকে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। নাট্যশিল্পীদের সাহায্যে আর বিচ্ছিন্ন কোনও উদ্যোগ নয়, সোশ্যাল মিডিয়াতেই এবার পেজ খুলে একটা ছাতার তলায় চলে এলেন পাঁচজন।
সে ছাতারই পোশাকি নাম ‘আরোগ্য’। বয়স মোটে দু’মাস, এরই মধ্যে বারো জনের আরোগ্যের ব্যবস্থাও করে ফেলেছে সে! শুধু শহর কলকাতা নয়। নৈহাটি, দুই পরগনা, বোলপুর, মালদহ পেরিয়ে ‘আরোগ্য’ পৌঁছে গিয়েছে উত্তরবঙ্গেও। বেড়েছে সদস্যও। পাঁচ নয়, ‘আরোগ্য’র যোদ্ধা এখন সাত--- সত্য জিৎ, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, রাজর্ষি চক্রবর্তী, বসন্ত পাথ্রডকর, নীলাঞ্জন হালদার, কৌশিক পৈলান ও দীপাশ্রী দত্ত।
ভাবনাটি ঠিক কীরকম? দলের অন্যতম সত্য জিৎ বললেন, ‘বিভিন্ন অডিটোরিয়াম ও ওপেন স্পেসের মালিক-কতৃর্পক্ষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছি আমরা। বিনামূল্যে জায়গাটি ব্যবহার করার অনুমতি চাইছি। অনুমতি মিললে স্থানীয়, পরিচিত নাট্যদলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করছি। বিনামূল্যে আরোগ্যর মঞ্চে এসে নাটক দেখানোর অনুরোধ জানাচ্ছি তাদের। টিকিট বিক্রি করে যে টাকাটা উঠছে, সেটাই দুঃস্থ-প্রবীণ নাট্যশিল্পীদের হাতে তুলে দিচ্ছি আমরা।’
গোবরডাঙা সংস্কৃতি কেন্দ্রের মঞ্চে, জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘আরোগ্য’। নয় নয় করে এখন ৩২-এরও বেশি সঙ্গী তার। যার মধ্যে রয়েছে কলকাতা ইফটা, A বং পজেটিভ, কসবা অর্ঘ্য, অল্টারনেটিভ লিভিং থিয়েটার, হাওড়া জোনাকি, প্রোজেক্ট প্রমিথিউস, পুষ্পক নাট্যগোষ্ঠী, হিপোক্রিটস, হাতিবাগান স্পর্শ, থিয়েটার ওয়ার্কার্স রেপার্টারী, থিয়েটার শাইনের মতো নাট্যদলও!
তবে শুধুই প্রবীণ-অভাবী শিল্পীরা নন।
‘আরোগ্য’কে ধীরে ধীরে সব বয়সেরই নাট্যশিল্পীর অন্যতম ভরসার জায়গা করে তুলতে চান সত্য জিতরা। অর্থাভাবে পড়াশোনা বন্ধ হতে বসেছিল আমতলার বাসিন্দা, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকের ছাত্রী সংযুক্তা ঘোষের। নাটকের ডালি নিয়ে এবার তাঁরই পাশে দাঁড়িয়েছে ‘আরোগ্য’। শুধু অর্থ সাহায্যই নয়, মেয়েটির শিল্পী-সত্তা টিকিয়ে রাখার সব চেষ্টাই করছেন তাঁরা।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ভর করে আর কত দিন? নথিভুক্ত সংস্থার ছাপ না থাকলে বিষয়টি তো বেআইনিও বটে? সত্য জিৎরা জানান, রেজিস্ট্রেশনের জন্য ইতিমধ্যেই আবেদন করে ফেলেছেন তাঁরা। তিন মাসের মধ্যেই ‘আরোগ্য’ পাকাপোক্ত একটা ভিতও পাবে।
‘আরোগ্য’র পাশাপাশিই শিল্পী সতীশ সাউয়ের পাশে দাঁড়াতে পৃথক ভাবে উদ্যোগী হয়েছেন অভিনেত্রী সুদীপা বসু। সেপ্টেম্বরের প্রথমে, নিভা আটর্সের সহযোগিতায় একদিনের ‘থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল’-এর আয়োজন হচ্ছে। ইন্দ্রাশিস লাহিড়ির তিনটি নাটক মঞ্চস্থ হবে সেখানে। টিকিট বিক্রির পুরো টাকাটাই সতীশবাবুর পরিবারের হাতে তুলে দেবেন সুদীপারা।