দোষ তাঁদের নয়৷ তাঁরা পরিস্থিতির শিকার৷ তাঁদের একসময়ে বাড়ি ছিল , নিজস্ব পাড়া ছিল , সংস্কৃতি ছিল৷ কিন্ত্ত দেশভাগ , বিতাড়ণের মাঝে আটকে পড়ে তাঁরা শুধুই ‘শরণার্থী’৷ গড়ে উঠেছে তাঁদের কলোনি৷ বেঁচে আছেন অনিশ্চয়তায় , কোনও মতে৷ সমুদ্র পার হতে গিয়ে মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়েছে সিরিয়া -র শিশু৷ লাল জামা পরে সমুদ্রসৈকতে যার উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহ আমাদের আঁতকে দিয়েছে৷ কিলিনোচ্চি নগর , মালাইতিভুর জঙ্গলে যখন শ্রীলঙ্কার সেনা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে , তারও মাঝে আটকে ছিলেন জাফনা শরণার্থীরা৷ এদিকে রোহিঙ্গাদের তাড়া করছে ব্রহ্মদেশের সেনা৷
ভারত , বাংলাদেশও তাদের আশ্রয় দিতে নারাজ৷ অতএব শেষ হয়নি শরণার্থীদের গল্প৷ বরং ঘটেই চলেছে৷ তাই ঋত্মিক ঘটকের সেই ছায়াছবি -ও তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি৷ এক্ষেত্রে মঞ্চে৷ মাধ্যম হিসেবে নাটক এবং ছায়াছবি অনেকটাই আলাদা৷ দু’টোর আলাদা আলাদা প্রকাশভঙ্গি আছে৷ উপস্থাপনার পদ্ধতিগত তফাত আছে৷ কিন্ত্ত কাহিনি একই রকম রেখে একটা সিনেমা যখন নাটক হয়ে ওঠে , তার অন্য একটা স্বাদ আসে বটে ! মনে রাখতে হবে এটাও কিন্ত্ত একটা ফর্ম৷ মুম্বইতে এমন কাজ হয়৷ যেমন মহেশ ভাটের ‘অর্থ’, ‘সারাংশ ’, ‘ড্যাডি ’ মঞ্চে অভিনীত হয়েছে৷ বাংলায়ও ‘মেয়েটি ’, ‘গল্প হলেও সত্যি ’ হয়েছে , তবে কম৷ এমন একটা ল্যান্ডমার্ক ছবি , মানুষ ঋত্মিক ঘটকের সঙ্গে তুলনা করবেন সেটা স্বাভাবিক৷ কিন্ত্ত ভুললে চলবে না যে ঋত্মিক নিজেও মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ নাটকের কিছু আঙ্গিক তাই তাঁর ছবির মধ্যে চলে এসেছিল সাবলীলভাবেই৷ সেই ব্যাপারটাই আরও উসকে দিয়েছেন ব্রাত্য৷
সুন্দর স্ক্রিপ্ট করেছেন উজ্জ্বল৷ নাটকে কাহিনির প্যাটার্ন, ঘটনার গতি -প্রকৃতি প্রায় একই রাখা হয়েছে৷ সেই কলোনিজীবন , দেশভাগ , কলোনি বাসিন্দাদের জীবনের লড়াই , তাঁদের নিয়ে রাজনীতি এই সবই রয়েছে৷ কিন্ত্ত সেসব ঘটনাকে বইয়ে দেওয়া হয়েছে নাটক -খাতে৷ প্রজেকশনের খুব ইন্টারেস্টিং ব্যবহার রয়েছে৷ পর্দায় কথা বলতে বলতে চরিত্র বেরিয়ে আসছেন মঞ্চে৷ আবার মঞ্চে উপস্থিত চরিত্ররা পর্দার সঙ্গে কথোপকথন করছেন৷ এরই পাশাপাশি , হঠাত্ করেই ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ’ গানে সেই ছায়াছবির দৃশ্য ! মানে অনিল চট্টোপাধ্যায় আর সুপ্রিয়াদেবী৷ অর্থাত্ ছবির থেকেই যে মঞ্চ উপস্থাপনা তা ভুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা কিংবা উদ্দেশ্য কিন্ত্ত নয় এ নাটকের৷ এটা আরও এক রকমের উপস্থাপনা৷
অনিলবাবু, সুপ্রিয়া দেবীর কথা যখন উঠলোই , তখন এই অবসরে কে কোন চরিত্রে অভিনয় করছেন সেদিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে৷ মাধব মাস্টারের ভূমিকায় (বিজন ভট্টাচার্য) পাওয়া গিয়েছে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়কে , রমলা -র রোলে (গীতা দে ) সুরঞ্জনা দাশগুন্ত , শংকর -এর রোলে (অনিল চট্টোপাধ্যায় ) পার্থ ভৌমিক , নীতা -র ভূমিকায় (সুপ্রিয়া দেবী ) পৌলমী বসু, গীতা -র ভূমিকায় (গীতা ঘটক ) কথাকলি দেব৷ সনত্ ও জ্যোতিন হিসেবে রয়েছেন যথাক্রমে অনির্বাণ ঘোষ ও তরঙ্গ সরকার৷ চমত্কার টিম -ওয়ার্ক৷
বিজন ভট্চাযের জামা গায়ে পরার কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল শুভাশিসের জন্য৷ কিন্ত্ত অত্যন্ত বুদ্ধির সঙ্গে রোলটা তিনি নিজের মতো করেই এক্সিকিউট করেছেন , বিজনের কথা সম্ভবত মাথায়ই বসতে দেননি৷ তাই চমত্কার লেগেছে৷ প্রায় একই পথে হেঁটেছেন পৌলমীও৷ সুপ্রিয়াদেবী নয় , নিজের মতো করে নিয়েছেন চরিত্রকে৷ তাছাড়া , তিনি খানিকটা রোগা হয়েছেন৷ মঞ্চের উপর বিচরণও আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে৷ নীতার গায়ের রঙ ‘কালো ’ আমরা জানি৷ তাই বলে পৌলমীকে কালো হতে হবে এমন কথা নেই৷ ‘কালো ’ কিন্ত্ত এক্ষেত্রে একটা রূপক৷ ভারী গলায় এবং লম্বা চেহারায় ক্ল্যাসিক্যাল গায়ক দাদা হিসেবে ভালো লাগলো পার্থ ভৌমিককেও৷ কাফকার -র ‘মেটামরফোসিস ’ প্রসঙ্গ নাটকে অন্য মাত্রা এনেছে৷ সেই গ্রিগরি , যে পরিবারে অপরিহার্য ছিল , হঠাত্ সকালে উঠে দেখল সে পতঙ্গ হয়ে গিয়েছে৷ বাড়িতে তার প্রয়োজন ফুরলো৷ গ্রিগরি মিশে গেল নীতার সঙ্গে৷ কিংবা হাহাকারের মাঝে মাধব মাস্টার যখন বলেন এলিয়টের সেই লাইন , ‘উই আর দ্য হলো মেন / উই আর দ্য স্টাফড মেন ’, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ এক সুতোয় বাঁধা পড়েন৷ ওই তো গুলির তাড়া খেয়ে সীমান্তে ছুটে যাচ্ছে এক যুবতী৷ হয়তো রোহিঙ্গা আর্তিতে বলছে , ‘দাদা , আমি বাঁচতে চাই !
সেই মেঘে আজও ঢেকে তারা
বুদ্ধের অপেক্ষায় একটি রাত
অদ্ভুত আঁধার এক ! আর তাতেই শুরু হচ্ছে নাটক৷ গৌতম বুদ্ধ-র মৃত্যু হবে রাত্রির তৃতীয় প্রহরে৷ আর এ সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন ভিক্ষু দেবদত্ত৷ তিনি নিজেও মৃত্যুর প্রহর গুনছেন৷ তিনিও মারণরোগে আচ্ছন্ন৷ অতএব থাকে শুধু অন্ধকার ... কিন্ত্ত মুখোমুখি বসা হবে কি ? দেখা হবে কি দু’জনের ? হতে পারে৷ আবার নাও পারে৷ তবুও স্মৃতির ঝুলিটায় একবার ধুলো ঝেড়ে নিলে মনে পড়ে যেতে পারে : দেবদত্ত ছিলেন বুদ্ধের জ্ঞাতিভাই৷ ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু৷
বহুযুগের শিষ্যও বটে৷ আর সময় যতই এগিয়েছে , যত তাঁরা বড় হয়েছেন , সম্পর্কের মাঝে ক্রমাগত দানা বেঁধেছে যা কিছু অপ্রীতিকর , যা কিছু অবর্ণনীয় ঈর্ষার৷ কিন্ত্ত সেসব যখন ঘটেছে , তখন তো ঘোড়া ছুটিয়েছে যৌবনের মদ -মত্ততা৷ এখন যে দু’জনই বয়সে ধূসরিত৷ দাঁড়িয়ে আছেন জীবনের প্রান্তলগ্নে৷ বুদ্ধদেব কি এদিন ডেকে নেবেন সেই ষড়যন্ত্রকারীকে ? ডাকবেন সংঘের অভ্যন্তরে ? নাকি তিনি নিষ্ঠুর হতে চাইবেন ? নির্দয় তবে তিনিও হতে পারেন !প্রভু বুদ্ধের দর্শনের অপেক্ষায় , অনুমতির প্রত্যাশী দেবদত্ত যখন বসে থাকেন , তখন সেখানকার অগুনতি শ্রমণ , ভিক্ষু-ভিক্ষুনী ও সংঘের লোকেদের সঙ্গে অপেক্ষা করি আমরাও৷ আর ছায়াছবির ফ্ল্যাশব্যাকের মতো আমরা অতীতে চলে যেতে থাকি , যখন বুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা হত্যা পরিকল্পনা আঁটছেন দেবদত্ত৷
মনে রাখতে হবে , বুদ্ধের উত্থানকেও কিন্ত্ত অনেকেই একটা অন্য রকম পলিটিক্যাল পরিবর্তন হিসেবে দেখেন৷ এই প্রথম ব্রাহ্মণ সন্তান না হয়েও কেউ ধর্মগুরু হয়ে উঠলেন এশিয়ায়৷ সিদ্ধার্থ তো রাজপুত্র৷ অতএব , ক্ষত্রিয়পুত্র হলেন ধর্মনিয়ন্তা৷ আর অনুগামীরা নানা বর্ণের৷ বর্ণ আর শ্রেণিভেদ ঘুচিয়ে যে দর্শন তিনি সামনে আনলেন , তা ব্রাহ্মণ্য ক্ষমতা -স্তম্ভে ফাটল ধরালো বলাই বাহুল্য৷ এই যে পাওয়ার চেঞ্জ, এটার সুযোগ একা কেমন করে বুদ্ধকে ভোগ করতে দেওয়া যায় ? তাই সংঘ দখল করতে মরিয়া হয়ে গেলেন দেবদত্ত৷ মঠ দখল করলেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে রাজাকে৷ কিন্ত্ত রাজা যদি তাঁকে পছন্দ না করেন ? বেশ তো পুত্রকে লেলিয়ে দিতে হবে পিতার বিরুদ্ধে৷ রাজপুত্র অজাতশত্রু , পিতা বিম্বিসারকে হত্যা করতে পেরেছিলেন৷ পেয়েছিলেন রাজত্ব৷ কিন্ত্ত , দেবদত্ত সংঘ চালক হতে পারেননি৷ যদিও কোকালিকের মতো সাঙ্যাতের সাহায্যে তিনি বেশ কয়েকবার বুদ্ধ হত্যার চেষ্টা করেন৷ একবার নিয়ে আসেন ভাড়াটে ধনুর্ধর৷ তিনি বুদ্ধের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে নেন৷ লেলিয়ে দেওয়া হয় পাগলা হাতিকে৷ শান্ত হয়ে যায় সেও৷
শেষটায় পাহাড়ের উপর থেকে প্রস্তরখণ্ড গড়িয়ে দেওয়া হয়৷ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তা -ও৷ ব্যর্থ দেবদত্তকে ফেলে চলে যায় তাঁর অনুগামীরা৷ এই প্রতিটা হত্যা চক্রান্তের রচনা এবং তা কার্যকর করার দৃশ্যগুলি অসম্ভব ভালো থিয়েট্রিক্যাল উপস্থাপনা করেছেন বিপ্লব৷ আর ব্রাত্য -র স্ক্রিপ্ট আমাদের পালি -ভাষার মেজাজ দিতে পেরেছে৷ সে সময়ের রাজনীতিটা বুঝতে সাহায্য করেছে৷ শুধু মিউজিক পার্টটা আরেকটু সে সময়ের মতো হওয়া দরকার ছিল৷ আর অতো জন শ্রমণের মুন্ডিত মস্তকের মেক -আপেও যত্ন দরকার ছিল৷ সকলকেই দেখে মনে হয়েছে মাথায় কী যেন একটা চাপানো৷ বেশি বয়সের দেবদত্ত হিসেবে কৌশিক চট্টোপাধ্যায় আর কোকালিকের ভূমিকায় শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় অনবদ্য৷ কম বয়সের দেবদত্ত , অজাতশত্রু হিসেবে রাজর্ষি ও কেশবও ভালো৷ অসংখ্য চরিত্র নাটকে৷ তাই সকলের দলবদ্ধ প্রয়াস ছাড়া এ নাটক সম্ভব হত না৷ আর সেটের মধ্যে উঁচু-নিচু-ঢালু পাহাড়ের যে অসমান গতিবিধি রাখা হয়েছে , তা নাটকের ঘটনাপ্রবাহ , চক্রান্তের আড়াল -আবডাল , ক্ষমতার উত্থান -পতনকে বুঝতে সাহায্য করেছে৷ নাটকে আমরা দেখলাম , ধর্ম কেমন করে রাজনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে চায়৷ দেখলাম , সংঘ দখল নিতে বদ্ধপরিকর দেবদত্ত যে সব নিয়ম প্রবর্তন করতে চান , তা তিনি নিজে কোনও দিন মানতে পারবেন কীনা তা নিয়ে সংশয়ের শেষ নেই৷ এছাড়াও যে প্রশ্নটা আমাদের তাড়া করে তা হল , দেবদত্ত কেন এতদিন পর দেখা করতে এসেছেন বুদ্ধের কাছে ? কী উদ্দেশ্য তাঁর ? এও কি কোনও নতুন ষড়যন্ত্র ? নাকি শুধুই অনুশোচনা ! নাটক শুরুর আগের অন্ধকারের মধ্যেই আরও একবার তলিয়ে যাই আমরা৷
অন্যের জন্য সমব্যথী হওয়াটা খুব জরুরি
সেই ২০০৯ -এর পর কিউ , ওরফে কোয়াসার ঠাকোর পদমসি নিজের থিয়েটার নিয়ে এলেন কলকাতায়৷ বার্টোল্ট ব্রেখ্ট -এর ‘মাদার কারেজ ’৷ কিন্ত্ত তাঁর বাবা অ্যাডগুরু এবং থিয়েটার পরিচালক অ্যালেক পদমসির মতোই , কিউয়েরও কলকাতা বিশেষ পছন্দের৷ এমনিতে কিউ কলকাতায় প্রচুর ওয়ার্কশপ করান৷ কিন্ত্ত থিয়েটার সার্কিটে বলেন মুম্বই থেকে বেঙালুরু হয়ে দিল্লি হল থিয়েটারের জনপ্রিয় সার্কিট৷ সেখানে কলকাতা বাদ চলে যায় দূরত্বের জন্য৷ আর ‘মাদার কারেজ ’? কলকাতায় উষা গঙ্গোপাধ্যায়ের করা এই নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয়৷ উষা এটিকে প্রায় মাইলস্টোনের পর্যায় নিয়ে গিয়েছেন বলা চলে৷
সেখানে এত থিয়েটার থাকতে ক্ল্যাসিক্যাল এই নাটকটাই বেছে নিলেন কেন আজকের প্রজন্মের কিউ ? ‘গত বছর যখন নিয়ে বসেছিলাম দেখলাম এই সময়ে দাঁড়িয়ে ‘মাদার কারেজ ’-এর থেকে প্রসঙ্গিক নাটক কমই আছে৷ হ্যাঁ , ভারত যুদ্ধের মধ্যে নেই ঠিকই৷ বা যুদ্ধের আবহাওয়াও নেই৷ কিন্ত্ত কাশ্মীরে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যাবে কীরকম পরিস্থিতিতে আছে সেখানকার মানুষ৷ সঙ্গে গোটা দেশ৷ বৃহত্তর পৃথিবীর দিকে একবার তাকালেই বোঝা যাবে যে কতটা আমরা কমন সেন্স -এর থেকে দূরে চলে গিয়েছি৷ যারা সব থেকে বেশি ভায়োলেন্স তৈরি করে তাদের হাতেই এখন ক্ষমতা৷
৪০ -এর দশকে যখন ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটছে --- যে সময়টা নাটকটার প্রেক্ষিত , সেই প্রেক্ষিত আবার ফিরে এসেছে৷ তারই মাঝে একজন মহিলা বাঁচার তাগিদে লড়ছে৷ সে খাঁটি উদ্যোগপতি৷ সারভাইভাল যেখানে শেষ কথা৷ যেটা আমার সব থেকে অদ্ভুত লাগে সেটা হল যুদ্ধর কথা বলা হলেও সেই একই নিয়ম শান্তির জন্যও তো একইভাবে প্রযোজিত৷ মানে , একজন নারী যদি যুদ্ধ-পরিস্থিততে শরীর বেচে তাহলে যুদ্ধ নয় , এমন পরিস্থিতিতেও তো সে শরীর বেচতে বাধ্য হচ্ছে৷ এরই মাঝে এই কনফ্লিক্ট এবং যুদ্ধর আবহাওয়ার মধ্যে ধর্মের আনাগোনা৷ এখনকার রাম -রহিম তার অন্যতম বড় উদাহরণ৷ বা আইসিস ,’ বলেন কিউ৷ এরকম আরও প্রসঙ্গ আসে কিউয়ের নাটকে৷ কারা যুদ্ধ বাধায় ?
জওয়ানদের যুদ্ধে পাঠানো হয় , অথচ টাকা গোনে অন্যরা৷ বা শুধু ইরাক -ইরান যুদ্ধ নয় , আছে কুয়েত , আফগানিস্তানের যুদ্ধও৷ বলা হয় , কোনও মহান উদ্দেশ্যর জন্য যুদ্ধটা বাধানো হচ্ছে৷ ‘তাই নাটকটা একেবারেই আমাদের এই সময়ের জন্যই৷ মাদার মহিলার মতোই সারা পৃথিবী জুড়েই সারভাইভালের গল্প৷ তাদের পরিবার রক্ষা করার গল্প৷ আমার নাটক অরিজিন্যাল টেক্সট-এর মতো সময়ে সেট করা নয়৷ এমন একটা সময় করা যেটার সঙ্গে সবাই রিলেট করতে পারে৷ সেটা এ দেশ হতেও পারে , আবার নাও হতে পারে৷
যদি ভারতে যুদ্ধ লাগত , পরিস্থিতি কেমন হত সেটা ভেবেই করা৷ বর্ডার কোনটা , কোনটাই বা মেনল্যান্ড --- এই শিফ্টটা ধরা৷ এরই মধ্যে দুটো ধর্ম যারা নিজেদের মধ্যে মারপিট করছে ,’ বলেন কিউ৷ সঙ্গে যোগ করেন , ‘কেউ করছে না বলেই করলাম৷ বেশ রাগ -ই হচ্ছিল যে কেন কেউ করছে না৷ হিউম্যান বিহেভিয়ার নিয়ে এত খুঁটিনাটি আছে যে ইয়ত্তা নেই৷ ’ বহু অল্পবয়সীদের মতোই কিউ থিয়েটার বেছে নিয়েছেন৷ তাঁকে জিজ্ঞেস করা গেল এখনকার ইউথদের কোন জিনিসটা সব থেকে বেশি করে ভাবাচ্ছে ? উত্তর খুবই সোজা এবং প্রেডিক্টেবল --- সোশ্যাল মিডিয়া৷ ‘এতটা সময় আমরা এখন ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মে কাটাচ্ছি যে আমরা সহমর্মিতা হারিয়ে ফেলছি৷ সুতরাং ব্যাপারটা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনও ব্যাপারে যদি ‘আমি ’ সংক্রান্ত ব্যাপার না থাকে থাকি তাহলে সেটা আমার মাথাব্যথা নয় ,’ ঠিক এই জায়গাতেই কিউ মনে করেন যে শিল্পের কাজ বিশেষভাবে উল্লেখ্য৷
‘অন্যর সমব্যথী হওয়াটা কতটা জরুরি সেটা শিল্প শেখাতে পারে৷ বিশেষ করে পারফরমিং আর্টস৷ কারণ আজ আমাদের প্রাইমারি সোর্স অফ ইনফরমেশন মানুষ নয়৷ আরেকটা শঙ্কার কারণ , এই ইনফরমেশন ওভারলোডের জন্য আজকের যুবসম্প্রদায়ের আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হল সমস্ত ব্যাপারে আপডেটেড থাকা৷ সেটা একটা মানসিক স্টেবিলিটির সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে৷ আজকের যুবসম্প্রদায় অনেক কিছু জানলেও অনেক কম জানে৷ এবং সেরকম কারও কাছে গিয়ে যে জানবে সে রাস্তাও বন্ধ৷ তাদের এমনিতেই বহু প্রেশার৷ তার ওপর জ্ঞানের পাঠ এত শিফ্ট করার ফলে সেই ভারসাম্য রক্ষা করা আরও গুরুতর হয়ে যাচ্ছে৷ এটাই আমার মনে হয় এখনকার সমাজের সব চেয়ে বড় অসুখ ,’ বলেন কিউ৷ আরেকটা গুরুতর সমস্যা হল কমিউনিটি স্পেসের সমস্যা৷ ‘আমাদের শপিং মল আছে গাদাগাদা , কিন্ত্ত কোনও কমিউনিটি স্পেস নেই৷ একটা শহর বানালে সেটার মধ্যে কমিউনিটি স্পেস থাকতেই হবে৷ এটা অনেকটা দুর্গাপুজোর মতো --- যেখানে সবাই একত্রিত হয়৷ এটা আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি৷ এখন তো ক্লাসরুমও এতটাই টেকস্যাভি যে প্রায় অফিস -স্পেসের মতোই মতো স্যানিটাইজড৷ বাচ্চাদেরই দেখুন না৷ সামনে টিভি না চললে কেউ খেতে চায় না৷ এটা খুবই দুঃখের৷ কারও সঙ্গে কথা বলা যায় না৷ এতটাই সবাই স্ক্রিন -অবসেসড৷ মাঠে খেলতে যাওয়া তো দূর কি বাত ,’ বলেন কিউ৷ বাবার মতো মিউজিক্যাল কোনওদিন করবেন না৷ ‘কারণ মিউজিক নিয়ে আমার টেকনিক্যাল জ্ঞান খুব কম৷ আমার ফর্ম নিয়েও খুব একটা মাথাব্যথা নেই৷ যদি একটা কাজ মিউজিক্যাল ফর্ম হয় তো হবে৷ আমার কাছে কন্টেন্টই শেষ কথা৷ বাবা শেক্সপিয়র ভালোবাসেন৷ আর আমার সমকালের নাটক বেশি ভালো লাগে তথাকথিত ক্ল্যাসিক্স –এর থেকে৷ ‘মাদার কারেজ ’ বোধহয় সব থেকে ক্ল্যাসিক্যাল নাটক যেটা করেছি৷ শেক্সপিয়র হয়তো করব কোনওদিন৷ বস্তারের ওপর নাটক ‘পাবর্তী ’জ ডার্ক চিলড্রেন ’ করব ঠিক করেছিলাম৷ তবে একটা বড় ব্যাপার হল ভারত অবশেষে বুঝতে পেরেছে যে ইংরিজি এখন একটা ভারতীয় ভাষাই৷ তাই এতে সাহিত্যসৃষ্টিও অনেক বেশি হচ্ছে৷ সুতরাং , এখন আর শুধু আর্থার মিলারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না ,’ বলেন তিনি৷
মুম্বইয়ে নাটকের হাল-হকিকত কেমন ? ‘মুম্বইতে যেটা সব থেকে বড় সমস্যা সেটা হল স্পেস -জায়গা৷ গত তিন বছরে ৬০-সিটার , ৩০-সিটারের নাটক তৈরির একটা ট্রেন্ড এসেছে৷ অন্যদিকে , আবার বিশাল বড় কাজও হচ্ছে৷ উদাহরণস্বরূপ , বলতে পারি ‘মুঘল -এ -আজম ’ নাটকের কথা যেটা সিনেমার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে৷ ১০০০-সিটার প্রেক্ষাগৃহে সেটার পর পর শো ’ হাউসফুল হচ্ছে , যার ন্যুনতম টিকিটের দাম ৩,০০০ টাকা৷ এই দুইয়ের মাঝখানে অন্যান্য নাটকগুলো হচ্ছে ,’ বলেন কিউ৷
শহরে বাংলাদেশি নাটকের উত্সব
বাংলাদেশের প্রাঙ্গণমোর নাট্যদল তাদের সাতটি নাটক নিয়ে এবার কলকাতায় নাট্যোত্সবের আয়োজন করেছে৷ কলকাতার দল নান্দীপট আয়োজিত এবং অন্য থিয়েটার ও পূর্ব-পশ্চিম নাট্যদল দুটির সহযোগিতায় ‘প্রাঙ্গণমোর বাংলাদেশ নাট্যোত্সব ২০১৭ ’শিরোনামে উত্সবটির উদ্বোধন হবে ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় , হো চি মিন সরণির সত্যজিত্ রায় অডিটোরিয়ামে (আইসিসিআর)৷ উদ্বোধন করবেন বিভাস চক্রবর্তী , অর্পিতা ঘোষ, গৌতম দে, মামুনুর রশিদ, লিয়াকত আলি লাকি, মোফআকখআরুল ইসলাম৷ ৬ দিন ব্যাপী এই উত্সব চলবে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত৷
অভিনীত হবে ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ (সঙ্গের ছবি), ‘ঈর্ষা’, ‘শেষের কবিতা’, ‘শ্যামাপ্রেম’, ‘বিবাদী সারগাম ’, ‘আওরঙ্গজেব’, ‘কনডেমড সেল’ নাটকগুলি৷ পরিচালনায় রয়েছেন নূনা আফরোজ , অনন্ত হিরা , শিশির রহমান , আউয়াল রেজা প্রমুখ৷ উত্সবে থাকছে সেমিনারও , যার বিষয় :কেমন ছিল , কেমন আছে , কেমন দেখতে চাই দুই বাংলার নাট্য সংস্কৃতির আদান-প্রদান৷ সেমিনারে বিষয় উপস্থাপনে থাকছেন বিভাস চক্রবর্তী ও মামুনুর রশিদ৷ এবং সেমিনারে অংশগ্রহণ করবেন প্রকাশ ভট্টাচার্য, গোলাম কুদ্দুস , দিলীপ দত্ত , দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, আশিস গোস্বামী, মোহিতবন্ধু অধিকারী, কিশোর সেনগুপ্ত প্রমুখ৷
কলকাতার কয়েকজন নাট্যপ্রেমী ও নাট্যব্যক্তিত্বকে সম্মাননাও প্রদান করা হবে উত্সবে৷ তাঁরা হলেন অমেলেশ দাশগুন্ত , সেলিম উর রহমান , মনোতোষ কুমার সাহা , সৌমিত্র মিত্র , সমর মিত্র , গৌতম হালদার ও অঞ্জন কাঞ্জিলাল৷ সমগ্র উত্সবে ছাকা ও কলকাতার সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৌরভ চট্টোপাধ্যায়৷ এপার ও ওপার বাংলার নাট্য সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করা ছ’দিন ব্যাপী এই উত্সবের অন্যতম উদ্দেশ্য৷
দেখা হল বিকেলের আলোয়
নাটক: তখন বিকেল রূপান্তর: মোহিত চট্টোপাধ্যায় নির্দেশনা: সীমা মুখোপাধ্যায় দল: রঙরূপ অভিনয়: বিমল চক্রবর্তী, সীমা মুখোপাধ্যায় রেটিং: তিন সময়ের চলে যাওয়া বড় অমোঘ৷ এইমাত্র যে সময়টাকে নতুন বলে ভাবছিলাম, লিখতে লিখতেই তা চলে যাচ্ছে অতীত কালে৷ যে চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছিলো, সামান্য অন্যমনস্কতাতেই তা জুড়িয়ে জল৷ পেনের মুখ খোলা রেখে উঠে পড়লাম তো কালি শুকিয়ে গেল! 'টাইম' যেমন 'হিলার', সব যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দেয়, তেমনই 'কিলার'-ও বটে৷ রূপ, যৌবন, শক্তি সবই একে একে খুন করে ফেলতে থাকে সময়৷ তবু 'মেনোপজ' তো আর 'ব্রেনোপজ' নয়৷ অতএব, মনের, মননের, ভাবনার, ভালোবাসার পা টিপে চলাটা বন্ধ হয় না৷ বয়স বাড়লেই বরং চুপ করে থাকা সময়গুলোয় নিজের সঙ্গে আড্ডা জমে ওঠে৷ স্মৃতি যেমন ফেরে তেমনই নতুন আলাপ হওয়া কারও জন্য একটা চিনচিনে অনুভূতিরও জন্ম দেয়৷ হতেই পারে, যখন দেখা হল 'তখন বিকেল'৷ তবু সময়টাকে মনে রেখে সময় নষ্ট করে কী লাভ! অ্যালেক্সি আরবুজভের লেখা 'ওল্ড ওয়ার্ল্ড' থেকে এ নাটক রচনা করেন মোহিত চট্টোপাধ্যায় এবং তা মঞ্চস্থ করে অসিত মুখোপাধ্যায়৷ বেশি বয়সের গভীর প্রেমের আশ্রিত সে প্রোডাকশন নতুন প্রজন্ম দেখেনি৷ সেই সুযোগটাই করে দিলেন সীমা মুখোপাধ্যায়৷ আরও একবার মঞ্চে নিয়ে এলেন ডাঃ পার্থ সান্যাল আর তাঁর অদ্ভুত পেশেন্ট উমা রায়'কে৷ চমত্কার অভিনয়ে কোথা দিয়ে দু'ঘণ্টা পার করে দেন বিমল চক্রবর্তী আর সীমা মুখোপাধ্যায়৷ 'অব্যক্ত'-র পর তাঁদের সৃষ্টিশীল জুটি আরও একবার ভালো লাগলো৷ খুব ছিমছাম সেট, পরিশীলিত আলো, কবিতা নাটককে উপযুক্ত সঙ্গত করেছে৷ দুটি চরিত্রের পঁচিশ দিনের কথোপকথন নিয়েই নাটক৷ রাশভারি ডাক্তারের ডিসিপ্লিন, গাম্ভীর্যের দেওয়াল ভেঙে ঢুকে পড়েন উমা৷ আড্ডা দেওয়া, কবিতা বলা, সূর্যোদয় দেখার জন্য কাকভোরে পাঁচিল ডিঙিয়ে বেরিয়ে পড়া, সব মিলিয়ে স্যানিটোরিয়ামে উমা এক ব্যতিক্রমী চরিত্র৷ তাঁর দামালপনার মাঝে পড়েই ধীরে ধীরে পাল্টে গেলেন ডাক্তার৷ তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে সময় কাটানো বাড়তেই থাকলো৷ তাঁরা গানের অনুষ্ঠানে গেলেন৷ বৃষ্টিতে ভিজলেন ছাতা উড়িয়ে দিয়ে৷ একদিন দু'জনে মিলে মদ্যপান করলেন৷ কে জানতো অমন সুন্দর নাচতে জানেন ডাক্তার! কিন্ত্ত এ সম্পর্কের পরিণতি কোথায়? ধু্যত মশাই, কে পরিণতি নিয়ে ভাবছে! 'বুড়িয়েছি বলে যে ফুরিয়েছি তা কিন্ত্ত নয়'৷ মুহূর্তগুলোর সাক্ষী থাকুন৷ প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দু'টো মানুষ কেমন করে নিয়ম ভেঙে জড়িয়ে পড়ছে নতুন সম্পর্কে, স্বপ্ন দেখছে, পরস্পরকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে, বয়সকে স্রেফ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে৷ নাটকের শেষে আলো যখন নিভে আসছে তখনও যেন মঞ্চের উপর ছড়িয়ে থাকে টফির মোড়ক, ভাঙা ছাতা, ছেঁড়া বোতাম, ভেসে আসতে থাকে বৃষ্টির গন্ধ, শোনা যায় সমুদ্রের ঢেউ৷ দু'জনে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে যে কথা শুরু করেন তা আর শোনা যায় না৷ কেবল তাঁদের মাথা নাড়তে দেখা যায়৷ হাসতে দেখা যায়৷ সায় মেলাতে দেখা যায়৷ সূর্যাস্তের গেরুয়া আলোর চাদর মুড়ে ফেলে তাঁদের৷ কফির কাপে তখন ধোঁয়া উড়ছে৷---ইন্দ্রনীল শুক্লা
নাটকে নিজেকে দেখা যায় দর্শকের চোখে
শহরে পৌঁছাতেই বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর৷ দুপুরে বিমানবন্দরে পা রেখে , রাজারহাটে একটি হোটেলে সামান্য বিশ্রামের পরই শরমন যোশি রওনা দেন মোহিত মৈত্র মঞ্চের দিকে৷ পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ নাট্যগোষ্ঠী আয়োজিত ইন্দ্ররঙ মহোত্সবে ‘রাজু, রাজা , রাম অউর ম্যায় ’ নাটকটি অভিনয়ের জন্যই তাঁর শহরে আসা৷ দুপুরের পর থেকেই মোহিতের সামনে ছিল চমকে যাওয়ার মতো ভিড়৷ সমস্ত টিকিট নিঃশেষিত৷ এবং হলের সিঁড়িতে , দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নাটক দেখার জন্য আয়োজকদের কাছে অনুনয় -বিনয় করছেন নাট্যমোদী মানুষ৷
এরই মধ্যে প্রেক্ষাগৃহ চত্বরের লোহার গেটে ভিড় সরিয়ে শরমনকে নিয়ে ঢুকে পড়ল গাড়ি৷ ঢোকার পথে অভিনেতা জানিয়ে গেলেন মেক -আপ শেষ করে গ্রিনরুমে বসবেন কথা বলতে৷ মেক -আপ শেষ হল যখন , তার কিছু সময় পরেই শো শুরু হওয়ার কথা৷ সেটা ভাবতে ভাবতে সাজঘরে প্রবেশের পর জেনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে , দর্শকদের ঢুকতে অনেক সময় লেগে যাবে বলেই শোয়ের সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে খানিকটা৷ অতএব কথা শুরু হল৷ কলকাতায় তাঁর জনপ্রিয়তা তো ভিড়েই প্রমাণিত ... কথা শেষ করতে না দিয়ে শরমন বললেন , ‘কলকাতার মানুষ থিয়েটারটা বোঝেন , এটা সত্যি৷ নাহলে ভাবুন তো এই নাটকটা এই নিয়ে পাঁচ বার এ শহরে এসে পড়লাম৷ ক’টা শহরে আর এভাবে এক নাটক নিয়ে বার বার আসতে হয় ?’এই বিশেষ নাটকটিতে স্টেজ পারফরম্যান্স খুব ইম্পর্ট্যান্ট৷ নাটকে মদন সুখচন্দানি নামে এক মিলিওনিয়ার শিল্পপতি আপাতভাবে খুন হওয়ার পর তাঁর সম্পত্তি দখল করার জন্য আত্মীয় ও কর্মীরা আলাদা আলাদাভাবে মদনের মতো দেখতে তিন জনকে হাজির করে৷
অর্থাত্ এই তিন জন (রাজু, রাজা এবং রাম ) এবং মূল মদন চারটি চরিত্রেই একইসঙ্গে অভিনয় করতে থাকেন শরমন৷ ব্যাপারটা কেমন করে ম্যানেজ করা হয় জানতে চাওয়ায় অভিনেতা বলছেন , ‘দেখুন চরিত্রগুলো যখন একইসঙ্গে মঞ্চে থাকছে তখন তো আর আমার পক্ষে চারজন হওয়া সম্ভব নয়৷ এ নাটকে মোট তিন জন বডি ডামি ব্যবহার করা হয়৷ কিন্ত্ত টাইমিংটা এত দ্রুত রাখা হয় যে মঞ্চে একটা ম্যাজিকাল ইলিউশন তৈরি হয়৷ ’ মানুষ বোঝেন না ? ‘আমি নিশ্চিত নিয়মিত নাটক দেখা মানুষ দিব্যি বোঝেন যে বডি -ডামি রয়েছে৷ তবু চোখের সামনে যেভাবে তা উপস্থাপিত হচ্ছে , সেটাই তাঁদের আকৃষ্ট করে৷ ’ছবি আর নাটক কোনটা তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? ‘অবশ্যই নাটক৷ লাইভ অডিয়েন্সের যে মজা সেটা আর কিছুতে নেই৷ ছবিতে অভিনয়ের পর নিজেকে পর্দায় দেখা যায় , কিন্ত্ত নাটকে নিজেকে দেখা যায় না , নিজেকে দেখতে পাওয়া যায় দর্শকের চোখে , উচ্ছ্বাসে৷ তাছাড়া সিনেমায় ভুল শট দিলে তা আবার টেক করা যায়৷ কিন্ত্ত মঞ্চের উপরে একবারেই ঠিক করতে হবে৷ সেদিক দিয়ে একটা ভালনারেবিলিটি আছে৷ কিন্ত্ত সেটাই তো চ্যালেঞ্জ !’থিয়েটার করতে গিয়ে আমাদের দেশে কী কী ঘাটতি তাঁর চোখে পড়ছে ?
শরমন বলছেন , ‘দেখুন হল অনেক থাকলে তবে হলের ঘাটতি নিয়ে আলোচনা করা যায়৷ প্রথমেই বলা দরকার আরও অনেক হল দরকার৷ নাহলে নাটক বাঁচবে কেমন করে ? হ্যাঁ, হলের মান উন্নয়ন করাটাও জরুরি৷ ভারী সেট হলে , বড় স্কেলের প্রোডাকশন নামাতে হলে পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটানো ভীষণ জরুরি৷ ’ সারা দেশে তো থিয়েটার করেন , কোথায় কোথায় অভিনয় করতে ভালো লাগে ? ‘কলকাতার কথা তো বললামই৷ পাঞ্জাব , গুজরাট , মহারাষ্ট্রের মানুষও নাটক দেখতে ভালোবাসেন৷ খুব ভালো অডিয়েন্স পাই৷ ’সিনেমায় ‘থ্রি -ইডিয়টস ’, ‘রং দে বাসন্তী ’, ‘লাইফ ইন আ মেট্রো ’ দিয়ে যিনি শুরু করেছিলেন , তাঁর ফিল্মিগ্রাফটা কি খানিক নেমে গিয়েছে ? ‘দেখুন কিছু ছবি চলবে , কিছু চলবে না৷ কিন্ত্ত কাজ তো করে যেতেই হবে৷ আমি তো কাজের মধ্যেই রয়েছি৷ সামনের বছরই আমার তিনটে ছবি মুক্তি পাওয়ার কথা৷ ’
যেমন ? ‘একটা রোম্যান্টিক কমেডির কাজ শুরু করতে চলেছি আপনাদের শহরের পরিচালক অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে৷ ‘কাশী ’ নামে একটা থ্রিলারের কাজ শুরু করেছি৷ এবং নাম ঠিক না হওয়া আরও একটা কমেডি হাতে আছে৷ অর্থাত্ কাজ তো রয়েছে হাতে৷ ’কলকাতার বাংলা থিয়েটার দেখেছেন ? ‘এইটা আমার সত্যিকারের একটা আফশোস বলতে পারেন৷ এতবার এখানে এসেছি , প্রতিবারই দেখতে চেয়েছি , কিন্ত্ত সময় করে উঠতে পারিনি৷ এবারও হবে না !’গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় ফার্স্ট বেল বেজে উঠল৷ প্রস্ত্তত অডিয়েন্স৷ তৈরি শরমনও৷
‘ফেমাস, গ্ল্যামারাস হওয়ার উদ্যোগ নিইনি’
এমন দিনে শহরে এলেন যেদিন fকনা শাহরুখ খানও কলকাতায় , আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের উদ্বোধনে৷ কলকাতার জন্য এক্কেবারে ‘কভি হাঁ, কভি না ’ দিবস ! শুনেই বেশ অবাক হয়ে গেলেন সুচিত্রা কৃষ্ণমূর্তি, তারপর স্বতঃস্ফর্ত হেসে বললেন , ‘সত্যি ! শাহরুখও আজ কলকাতায় ? কী কাণ্ড দেখুন৷ দারুন কাকতালীয় তো৷ ফোন করতে হবে৷ ’ দু’জনেরই কেরিয়ারের গোড়ার দিকের ওই ছবিটি (কভি হাঁ, কভি না )আজও মনে রেখেছেন বহু মানুষ৷ শাহরুখের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে এখনও ? ‘ওমা , কেন থাকবে না ? কথা হয় তো মাঝে মাঝে৷ ’
কিন্ত্ত কুন্দন শাহ পরিচালিত অমন একটা সুপারহিট দিয়ে বলিউড ডেবিউ করার পর সুচিত্রা যেন হারিয়ে গেলেন৷ মানুষ তাঁর পরের ছবির জন্য অপেক্ষা করেছে , কিন্ত্ত তিনি আর আসেননি৷ ফিরেছেন প্রায় এক দশক পর৷ তাও সেটা অন্য ধারার ছবি৷ রামগোপাল ভার্মা-র থ্রিলার ‘মাই ওয়াইফস মার্ডার’-এ , অনিল কাপুরের স্ত্রী হিসেবে৷ এমনটা কেন ? সামান্য যেন ম্লান হল মুখ৷ মুহূর্তেই সেই বিষণ্ণতা কাটিয়ে বললেন , ‘আসলে তারপর বিয়ে করে ফেললাম যে৷ অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম ...৷’ তাহলে তিনিও বিশ্বাস করেন যে বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের জীবনের প্রিয়োরিটিগুলো বদলে যায় ? একটু ভেবে বলছেন , ‘অস্বীকার করি কেমন করে৷ হ্যাঁ, পাল্টায়৷ আসলে অনেক মেয়েই কম বয়সে ছোট ছোট ভুল করে , যা পরে তাকে বড় কষ্ট দেয়৷ কী বলি , সিলি মিসটেক !’
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক শেখর কাপুরের সঙ্গে বিয়ে এবং ডিভোর্স ইত্যাদি পর্ব নিয়ে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা হোক তা তিনি চাননি৷ তাই খানিক ভাববাচ্যে প্রশ্ন রাখতে হল , দু’জন ক্রিয়েটিভ মানুষের একসঙ্গে থাকাটা কি বেশ কঠিন ব্যাপার ? সুচিত্রা বলছেন , ‘শুধু ক্রিয়েটিভ মানুষ কেন , ডাক্তার -ইঞ্জিনিয়ার -চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট সবের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷ আসলে ব্যাপারটা হল দম্পতির পরস্পরের উপর আস্থা আর সম্মান রয়েছে কীনা৷ তা না থাকলে দুটো ক্রিয়েটিভ মানুষ কেন , কারওরই সম্পর্ক টিকবে না৷ আর সম্পর্ক যদি নাও থাকে তাহলেও পরস্পরের কাজের ব্যাপারে শ্রদ্ধা থেকে যাওয়া উচিত৷ ’ কাজে শ্রদ্ধা থেকে যাওয়ার প্রসঙ্গে জানতে ইচ্ছে হল , তাহলে কি তিনি শেখর কাপুরের প্রশংসিত ছবি ‘ব্যান্ডিট কুইন ’ কিংবা কুইন ‘এলিজাবেথ ’ এখনও সুযোগ পেলে দেখেন ? উত্তর নয় , পাল্টা প্রশ্ন করলেন সুচিত্রা , ‘আচ্ছা , ‘ড্রামা কুইন ’ ছাড়া আপনি সমস্ত কুইন এনে জড়ো করছেন কেন বলুন তো ? নাটকের কথা কিছু জানতে চাইবেন না ?’ প্রসঙ্গত , কলকাতার দল পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ আয়োজিত ইন্দ্ররঙ মহোত্সবে ‘ড্রামা কুইন ’ নাটকটি মঞ্চস্থ করতেই তাঁর কলকাতায় আসা৷ ১৯১৩ সালে আত্মজীবনী লেখেন সুচিত্রা৷ এ নাটক তিনি রচনা করেছেন সেই বইয়েরই ছায়াবলম্বনে৷ পরিচালনায় ইনায়ত আলি সামি৷
জানতে চাইলাম , নিজের জীবন নিয়ে নাটক করা , এটা তো বেশ একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ? ‘হ্যাঁ, চ্যালেঞ্জিং৷ সেটা চরিত্রটার জন্য৷ এ নাটকে যেমন চরিত্র হিসেবে রামগোপাল ভার্মা , করণ জোহর প্রমুখ আসেন , তেমনই সুচিত্রাও এখানে একটা চরিত্র , যে চরিত্রে অভিনয় করছে সুচিত্রা কৃষ্ণমূর্তি৷ আমার জীবনের ছায়ায় তৈরি৷ একজন সিঙ্গল মাদারের জীবন যে কীনা সেলিব্রিটি বৃত্তে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে , এইরকম৷ চরিত্রটা এমনভাবে বানানো যে অনেক মাঝবয়সী মহিলাই এর সঙ্গে আইডেন্টিফাই করতে পারবেন৷’
এ নাটকের জন্য আলাদা করে প্রস্ত্ততি নিতে হয়েছিল ? ‘হ্যাঁ, হয়েছিল৷ প্রথম দিকে একটু নার্ভাস ছিলাম৷ স্টেজের পাশে প্রম্পটার রাখব এমনও ভেবেছিলাম৷ পরে সেটা কাটিয়ে ফেলি৷ আসলে আমি তো আজ থেকে নাটক করি না৷ স্কুল থেকে করি৷ তাই অসুবিধা হল না৷ ’ নাটক আর সিনেমা , কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কাছে ? ‘না এভাবে ভাগ করতে চাই না৷ থিয়েটারের থেকে আমি অভিনয় শিখেছি , ডিসিপ্লিন শিখেছি , ফোকাসড হতে শিখেছি৷ আর ছবিও তো আমি করতে চাই৷ কিন্ত্ত হাবিজাবি রোল আমার পছন্দ নয়৷ রোল পছন্দ হলে তবেই কাজ করব৷ ’
কিন্ত্ত মুম্বই ইন্ডাষ্ট্রি তো পাল্টাচ্ছে৷ তিনি কি ছবি বাছাইয়ে অত্যধিক খুঁতখুঁতে ? ‘সেটা একটু আছি বলতে পারেন৷ ’সুচিত্রা বহুমুখী৷ তিনি আঁকেনও৷ একজিবিশন হয়৷ ছবি বিক্রি হয়৷ তিনি বলছেন , ‘শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হবে কিন্ত্ত আমার পেন্টিংটা শুরু হয়েছিল একেবারে স্পিরিচ্যুয়াল ইনস্পিরেশনে৷ ২০০৪ সালের গণেশ চতুর্থীর দিন একজনের কথায় আঁকা শুরু করলাম৷ তারপর কী যে হল , টানা দু’সন্তাহ শুধু আঁকলাম৷ কোনও দিন এভাবে আঁকতাম না৷ সেই থেকে গোটা সতেরো এক্সিবিশন হল৷ শ ’খানেক ছবি বিক্রি হল৷ আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারি না !’
তাঁর গানের দিকটাও চমকে দেওয়ার মতো৷ সুচিত্রা গোয়ালিয়র ঘরানায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রশিক্ষণপ্রান্ত৷ বিশ্ববন্দিত সুরকার অ্যান্ড্রূ লয়েড ওয়েবারের সুরে তাঁর অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছিল৷ নিয়মিত তিনি গান করেন নাটকেও৷ তিনি প্লে-ব্যাক করার দিকে গেলেন না কেন ? ‘একটা কথা বলি , ভাববেন না হামবড়িয়া করে বলছি৷ আমি সত্যিই ফেমাস , গ্ল্যামারাস হওয়ার পিছনে ছুটিনি৷ সে সিনেমা বলুন আর গান , যখন যা খুশি করে গিয়েছি৷ মানুষ তাতেই যেটুকু যা চেনার চিনেছেন৷ আমি চেনানোর উদ্যোগ নিই নি৷ অনেক বছর আগে প্লে-ব্যাক কিন্ত্ত আমি করেছি৷ চালিয়ে যাইনি , এই আরকী ’, উদাসীন উত্তর তাঁর৷ আঁকা , লেখা , নাটক , সিনেমা , গান অ্যাত্তোকিছু ব্যালান্স করেন কেমন করে ? ‘ধুস ! ব্যালান্স করার দরকারটা কী ? যখন যেমন ইচ্ছে হয় করি৷ বেশি ভাবলে কোনওটাই করা হয় না দেখেছি৷ ’কলকাতা প্রসঙ্গে কোনও প্রশ্ন ছাড়া নিজেই বললেন , ‘আমি ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে প্রথম কলকাতায় (ক্যালকাটা নয় , ‘কলকাতা ’ই উচ্চারণ করলেন ) আসি , তারপর অনেকবার এসেছি৷ এখান থেকে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়েছি৷ কত্ত স্মৃতি৷ কলকাতা না , খুব অন্যরকম৷ ফর্ম হিসেবে , বাড়িগুলোর মাপের তারতম্যে , নানা পোশাকের মানুষ , পথ -ঘাট, কতো রকমের মুখ ...ভ্যারাইটি অফ কালারস ..বোঝা গেল পেইন্টার সুচিত্রা কথা শুরু করেছেন!
চোখ বাঁধা, তরোয়ালের ঘায়ে শসা দু’ভাগ
সবার হাতে সূচাগ্র তরোয়াল৷ সবার হাতে ঢাল৷ একে একে পরস্পরের সঙ্গে লড়াই শুরু করছে তারা মঞ্চে৷ প্রথমে ধীর লয়ে৷ ক্রমে অতি দ্রুত৷ এতটাই দ্রুত যে একেক সময় আর তরোয়ালের গতিবিধি ঠাহর করা যাচ্ছে না৷ কেবল ঝনাত্ ঝনাত্ শব্দ৷ এবং ধাতুর ঠোকাঠুকিতে জ্বলে উঠছে আগুনের ফুলকি৷ যেন সত্যিকারের এক লড়াই৷ এক ইঞ্চি তরোয়ালের বাঁকা চলন হলেই রক্তপাত নিশ্চিত৷ এই কসরত শেষে তাঁরা যখন প্রণাম করলেন তখনই মানুষের সম্বিত্ ফিরল৷ তাইতো এতো সত্যি নয়, এতো মণিপুর থেকে আসা দলের থাং-লা পারফরম্যান্স৷ তাতেও শেষ নয়৷ এরপর এক যুবকের চোখে মাটি লেপে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হল৷ হাতে তরোয়াল৷ মাটিতে শোয়ানো অপর যুবক, যার উদরে রাখা শসা৷ মঞ্চে বেশ কয়েকবার এদিক ওদিক মাপলেন তরোয়ালধারী৷ কয়েক পা আগু-পিছু করলেন৷ তারপর নিখুঁতভাবে তরোয়ালের কোপে দু’ভাগ করে ফেললেন শসা৷ মানুষ তখন হাততালি দিতেও ভুলে গিয়েছে! এতটাই টানটান ছিল ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা আয়োজিত আদি রঙ্গ মহোত্সবের কিছু কিছু মুহূর্ত৷ ওড়িশার কেওনঝড় জেলার কালিপুরিয়া ময়দানে অনুষ্ঠিত হল ১৭ থেকে ১৯ নভেম্বর৷
জনজাতির মানুষ পারফর্ম করলেন৷ গাইলেন, নাচলেন, নাটক দেখালেন৷ প্রতিটি উপস্থাপনাই স্বতন্ত্র৷ নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বলীয়ান৷ যেমন ধরা যাক, গুজরাটের ভারুচ প্রদেশ থেকে আসা সিডিগোমা উপজাতির মানুষ৷ সিড্ডি ধামাল নাচ পরিবেশন করলেন তাঁরা৷ এই জনজাতির কিন্ত্ত বেশ চমত্কার একটা ইতিহাস আছে৷ আজ থেকে সাতশো বছর আগে এঁদের কেউ দাস হিসেবে, ব্যবসায়ী প্রভুর ভৃত্য হিসেবে এসেছিলেন গুজরাটে৷ সেই থেকেই তাঁরা রয়ে গিয়েছেন৷ আর সেইসঙ্গে ভারতে রয়ে গিয়েছে একটুকরো আফ্রিকা৷ তাঁদের চেহারার বহিরাঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশের ছাপ এতোটাই স্পষ্ট যে হুট করে দেখলে কেউ হিন্দিতে কথা বলতে দু’বার ভাববেন৷ এঁরা নানা রকম পেশায় যুক্ত হয়ে গেলেও নিজেদের শতাব্দী প্রাচীন নাচ-গানের চর্চা রেখে দিয়েছেন৷ সেই টিপিক্যাল আফ্রিকান বিগ-ড্রামস সহযোগে নাচলেন, মুখে হরবোলার ডাকে পশুপাখির জানান দিলেন৷ শেষে একটা আশ্চর্য চমক৷ কয়েকজন শিল্পী নাচতে নাচতে হঠাত্ করে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলেন আস্ত নারকেল৷ সেটা নেমে আসার পথেই ‘হেড’ দিলেন৷ নারকেল ফেটে জল ছিটকে গেল দর্শকাসনে৷ এমন ‘র’ এনার্জি বুঝি জনজাতির মানুষই পরিবেশন করতে পারেন৷
তিনটি দিন ধরে এভাবেই আলাদা আলাদা স্মরণীয় মুহূর্ত গড়ে দিয়ে গেলেন জনজাতির মানুষ৷ রাজস্থানের চক্রী নাচের শিল্পীরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিল লাদাখ থেকে আসা গোষ্ঠী দাবড়ি নাচের শিল্পীরা৷ রাজ্য থেকে রাজ্যে নাচের ফর্ম কত্তো আলাদা৷ কতো সুন্দর অজানা সব নাম সেসব নাচের৷ উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম (তিওয়া ও বোরো), মেঘালয় (ওয়াংঘলা), মণিপুর (থাং-লা), ত্রিপুরা (হোজাগিরি)-র পারফরম্যান্স দেখা গিয়েছে৷ আবার পশ্চিমে গুজরাট (রাথওয়া), দক্ষিণে কেরল (কালারিপায়াট্টু), তেলেঙ্গানা (দুপ্পুু), কর্ণাটক (পুজাকুনিথা), পূর্বের ওড়িশা (হো- মুন্ডা ও ছৌ), পশ্চিমবঙ্গের সাঁওতালি ও রাইসেনসে দেখা গিয়েছে৷ ছত্তিশগড় (গোন্ডামারিয়া ও মান্ডারি), উত্তরপ্রদেশ (পাইডান্ডা)-এর শৈলীও মন কেড়েছে৷ সত্যি বলতে কী, এই উত্সবকে এক নিঃশ্বাসে বলতে পারাই সম্ভব নয়৷ এতো রকমের ফর্ম ইতিমধ্যেই ভারতে উপস্থিত! নতুন ফর্মের অনুসন্ধানেরই যেন প্রয়োজন নেই৷ এইসব ফর্মগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেই বুঝি বোবা করে দেওয়া যায় বিশ্বকে৷ তেমন কথাই বললেনও জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ওয়ামান কেন্দ্রে৷ বললেন ওড়িশার প্রতিনিধি মহান্তি মহাশয়৷
কেওনঝড় অঞ্চলটি এই উত্সবের পক্ষে ছিল চমত্কার৷ মূল জনপদটি পেরিয়ে গেলেই আশপাশটায় গোটা পাঁচেক বড় ঝরনা৷ আর দূরে শীতের আলতো কুয়াশা মেখে দাঁড়িয়ে মালভূমির টিলা পাহাড়৷ কয়েক কিলোমিটার গেলেই একটা ছোট্ট নদী, যার সত্যি সত্যিই নাম বৈতরণী৷ বন-জঙ্গলের গন্ধ, নীল পাহাড়ের হাতছানি, ঝরনার ঝির ঝির শব্দ... আদি শৈলের শেষ আশ্রয়!
দালেরের ‘তুনক তুনক ধুন’ কোরিয়ানরা জানে
যেন কোরিয়ায় এসে পড়েছি ! জিডি বিড়লা সভাঘরের তিনতলায় উঠে হঠাত্ এমনটাই মনে হল৷ একদল পীতবর্ণ ছটফটে ছেলেমেয়ে চুটিয়ে গল্প করছে৷ সকলেই কোরিয়ার৷ তাই ভাষা বোঝা যাচ্ছে না৷ ‘শেফ ’ নাটকের শো সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়েছে৷ সম্ভবত সেই মানসিক শান্তি থেকেই উচ্ছ্বাস , সেটা আন্দাজ করেই নেওয়া যাচ্ছে৷ তাঁদের কাছেই খোঁজ নেওয়া গেল এই শোয়ের পরিচালক হিউন সু কিম -এর৷ কিম ’কে পাওয়া গেল গ্রিন রুমে৷ সাংবাদিক শুনে তিনি ডাকলেন এক যুবককে , যাঁর নাম জুনহো লি৷ তিনিই ভাষাবন্ধনের দায়িত্ব নিলেন৷
ভারতের সঙ্গে কোরিয়ার সম্পর্ক প্রায় দু’হাজার বছরের প্রাচীন৷ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক চিরকাল ভালো৷ এই সম্পর্ককে কেমনভাবে দেখেন তিনি দেখেন ? কিম বলছেন , ‘দু’টো দেশের মধ্যে ভালো সম্পর্ক আছে এটা দেখতে তো সবসময়ই ভালো লাগে৷ সারা পৃথিবীতে নানা দেশ যখন রেষারেষির মধ্যে আছে , তখন দু’টো দেশ পরস্পরকে বন্ধু ভাবছে , পাশে থাকছে এটা নিশ্চয়ই ভালো৷ এটা যেন নষ্ট না হয় সবসময় দেখতে হবে৷ পারস্পরিক আদান -প্রদান আরও বাড়াতে হবে৷ ’উল্লেখ করা যেতে পারে , দু’টো দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো৷ কোরিয়ার স্যামসুং , এলজি , হুন্ডাইয়ের মতো কোম্পানিগুলো ভারতে বেশ একটা বলার মতো ব্যবসা করছে৷ এটা তিনি কেমনভাবে দেখেন ? কিম মনে করছেন , ‘পরস্পরের উপর বিশ্বাস থাকলে তবেই ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ সেটা তো ভালোই৷
কিন্ত্ত আমি নিজে যেহেতু সংস্কৃতি জগতের মানুষ , তাই সবসময়ই চাই দু’টো দেশের বাণিজ্যের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন যেন মজবুত হয়৷ আর সেই কাজটাই হওয়া সম্ভব সাংস্কৃতিক আদান -প্রদানের মধ্যে দিয়ে৷ গান -বাজনা -নাটক -সিনেমা মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে খুব সহজে৷ ’ দিল্লি থেকে আসা কোরিয়ার দূতাবাসের উচ্চপদস্থ কূটনৈতিক প্রতিনিধি সো ইয়েন পার্ক আগেই জানিয়েছিলেন ,
‘কোরিয়ার সংস্কৃতিকে কলকাতা তথা ভারতের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে৷ এমন অনুষ্ঠান ভারতের আরও নানা প্রান্তে আয়োজন করা হবে৷’ একই রকম বক্তব্য কলকাতায় কোরিয়ার কনসাল জেনারেল রাজীব কল -এরও৷ তাঁদের কথার প্রতিফলন সত্যিই মিলেছে ‘শেফ’ নাটকে৷
এ নাটকে গল্পের সাহচর্যে কোরিয়ার খাবার , ফ্যাশন , গান , নাচ সম্পর্কিত একটা সম্যক , সার্বিক ধারণা মিলেছে৷ মোটের উপর এখনকার (দক্ষিণ ) কোরিয়ায় যা যা চলছে সেই সবকিছু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম ‘শেফ ’৷ গোটা নাটকটিতে বিট -বক্সিং ব্যবহূত হল কখনও শুধুমাত্র ছন্দ আনার কাজে , কখনও বা ফোলি আর্টিস্টের মতো করে জল পড়া , কড়ায় রান্না করা ইত্যাদির শব্দ গড়ার জন্য৷ দুই বিট -বক্সার ছোয় সেংছুল আর কিম কিইয়াং একেবারে মাত করলেন৷ ‘বিট -বক্সিং ’ সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায় , কোনও বাদ্যযন্ত্র ছাড়া কেবল মুখে শব্দ করে নানা রিদম , স্পেশ্যাল এফেক্ট তৈরি করার এক বিশেষ শিল্পকলা৷ এই আর্ট কি তবে কোরিয়ায় খুব চলছে ?
হাত এলোমেলো দেখিয়ে কিম বলেন , ‘আসলে এটা নতুন একটা ফর্ম৷ কিন্ত্ত নাটকে তো সমস্ত রকমের ফর্মই ব্যবহার করা যায়৷ তাই না ? আমি ভেবে দেখলাম টিনএজারদের আকর্ষণ করতে এটা নাটকে রাখা যেতে পারে৷ বিট -বক্সিং কোরিয়ার ছেলে -পুলেরা খুব শিখছে এখন৷ মাস তিনেক ট্রেনিং নিয়েই পারফর্ম করতেও শুরু করে দিচ্ছে৷ ’ পাশাপাশি নাটকে দেখা গেল বি -বয়িং -ও৷ এটি হল হাতে ভর দিয়ে শূন্যে ভেসে এক বিশেষ ধরনের নৃত্য শৈলী , অনেকটা হিপ -হপের মতো৷ এই নাচ নাটকের বেশ কয়েকজন শেফ -চরিত্রকে পারফর্ম করতে দেখা গেল৷ বি -বয়িং ’ও তবে কোরিয়ার নিউ জেন খুব পছন্দ করছে ? ‘কেন এই নাচ আমাদের দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে , কেন টিন -এজাররা সহজেই এটা রন্ত করতে পেরেছে সেটা বোঝার জন্য একটা ব্যাপার আগে জানা দরকার৷ কোরিয়ার মার্শাল আর্ট চর্চা কিন্ত্ত কয়েকশো বছর ধরে হয়ে আসছে৷ নাচটা করার জন্য যে বেশ শারীরিক ফিটনেস দরকার সেটা তো দেখে বুঝতেই পেরেছেন৷ কিন্ত্ত যেহেতু কোরিয়ান ছেলে -মেয়েরা প্রায় সকলেই তাইকুনেডো শেখে , তাই তাদের কাছে এটা কোনও সমস্যাই হচ্ছে না৷ ’নাটকে তো দালের মেহেন্দির ‘তুনুক তুনুক ধুন ’ ব্যবহূত হল৷ আর তাতে জমিয়ে নাচলেনও পারফরমাররা৷ তাঁদের স্পষ্ট লিপ মেলাতেও দেখা গেল৷ এই গানটা ... কথা থামিয়ে দিয়ে কিম হাসতে হাসতে বলেন , ‘জানি খুব অবাক হয়েছেন৷ কিন্ত্ত যেটা শুনলে আরও অবাক হবেন তা হল , দালের মেহেন্দির অনেক গানই মানে না বুঝলেও কোরিয়ার মানুষ শোনেন৷ আর এই গানটা তো আমাদের দেশে খুব জনপ্রিয়৷ তাই মনে হল ভারতে যখন একটা পারফরম্যান্স হচ্ছে তখন এই গানটা রাখা যাক৷ দর্শকের উচ্ছ্বাসটাও স্পষ্ট চোখে পড়েছে৷ দু দেশের মানুষ একই গানে শরীর দোলাচ্ছেন ! অতএব আমার চেষ্টাটা সফল৷ সাংস্কৃতিক বন্ধন এভাবেই গড়ে ওঠে , যেটা একটু আগেই বলছিলাম৷ ’
নান্দীকারের নাট্যোত্সব
শাল, নলেন গুড়, মোয়ার পাশাপাশি কলকাতার মানুষের শীতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নান্দীকার উত্সব৷ এ বছরও তার ছেদ পড়বে না৷ এই বছর নান্দীকারের জাতীয় নাট্য উত্সব ৩৪ বছরে পড়ল৷ এতগুলো বছর ধরে শহরের মানুষকে নানা নাটক দেখার সুযোগ করে দিয়েছে নান্দীকার উত্সব৷ এবারের উত্সবেও চমত্কার সব নাটক প্রত্যক্ষ করতে পারবেন নাট্যমোদী মানুষ৷ নানা রঙের নাটকের ডালিতে সাজানো হয়েছে উত্সব৷ ১৬ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্সব চলবে অ্যাকাডেমি প্রেক্ষাগৃহে৷ দশ দিনের উত্সবে অন্যান্য বারের মতো এবারও ভিন রাজ্যের, ভিন্ন ভাষার নাটক দেখার সুযোগ মিলবে৷ দেখা যাবে মণিপুরের কলাক্ষেত্রের নাটক 'পেবেট'৷ আসছে হায়দরাবাদের রঙ্গকল্প-র সত্যব্রত রাউত পরিচালিত নাটক 'তুমহারা ভিনসেন্ট'৷ রয়েছে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-র 'অ্যাক্রস দ্য সি'৷ মুম্বইয়ের শিল্পকার গোষ্ঠীর 'কবীর'-ও দেখা যাবে৷ নান্দীকারের 'রানি কাদম্বিনী' (সঙ্গের ছবি), 'পাঞ্চজন্য'-ও আছে উত্সবে৷ 'এটিএম', 'মৃতু্যঞ্জয়'-এর মতো দলের পথনাটকগুলিও উপস্থাপিত হবে অ্যাকাডেমি চত্বরে৷ ব্রেখটের নাটক অবলম্বনে কৌশিক সেন পরিচালিত স্বপ্নসন্ধানী-র 'নির্ভয়া' এবং অরুণ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত মিনার্ভা নাট্যচর্চাকেন্দ্রের 'খড়ির গন্ডী' দেখা যাবে৷ এছাড়াও চেতনা-র 'ঘাসিরাম কোতয়াল', শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের 'বুকঝিম এক ভালোবাসা', পার্থপ্রতিম দেব পরিচালিত 'গয়নার বাক্স' এবং কৌশিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত 'কোজাগরী'-ও থাকছে৷ এবার বিশেষ সম্মাননা জ্ঞাপন করা হবে সাবিত্রী হেসনমকে৷ বয়সে আশি পেরনো নাট্যযুবক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুন্ত এবারও উত্সবের কান্ডারী৷ তিনি আশাপ্রকাশ করছেন কলকাতা ও শহরতলীর মানুষ উত্সবকে অন্যান্যবারের মতোই সফল করবেন৷---ইন্দ্রনীল শুক্লা
ব্রেজিলের মেয়ে হয়েও ফুটবল দেখেন না
মঞ্চাভিনেত্রী মেরিলিন ন্যুনেস৷ তাঁর থিয়েটার জীবন, গুরু জুলিয়া ভার্লে, দল, গ্রুপ থিয়েটারে গ্রান্ট সহ নানা ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিলেন ইন্দ্রনীল শুক্লা 'যখন বেশ ছোট ছিলাম তখন থেকেই আমার থিয়েটারের যাত্রা শুরু৷ স্কুলে নিয়মিত অভিনয় করেছি৷ ষোলো বছর বয়সে প্রথম সে রকম একটা বলার মতো মঞ্চে অভিনয় করি৷ সাও পাওলো শহর থেকে কিছুটা দূরে আমার বাড়ি ছিল৷ শহরতলী এলাকা বলা যায়৷ পাপেট থিয়েটার, স্ট্রিট থিয়েটার সব রকম ফর্মেই কাজ করেছি,' তাঁর থিয়েটারের জার্নি সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় এভাবেই শুরু করলেন ব্রাজিলের মঞ্চাভিনেত্রী মেরিলিন নু্যনেস৷ তিনি বলে চলেন, 'ইউনিভার্সিটি শেষ করে নিউ ইয়র্কে চলে যাই দু' বছরের জন্য৷ ওখানে ইংরেজি ভাষাটা খানিক শিখি৷ আরও বেশ কিছু বিষয়ের ট্রেনিং নিই৷ তারপর যাই ডেনমার্ক৷ সেখানেও অনেক কিছু শিখেছি থিয়েটারের৷ কলম্বিয়াতেও যাই৷ চোদ্দ দিনের ওয়ার্কশপ করি৷' খ্যাতনামা থিয়েটার ব্যক্তিত্ব জুলিয়া ভার্লের হাতে গড়া অভিনেত্রী হিসেবেই পরিচিতমেরিলিন৷ তাই জুলিয়ার সঙ্গে আলাপ পর্বের বিষয়টা জানতে ইচ্ছে হল৷ তিনি বলেন, '২০০৯ সালে জুলিয়া ভার্লের সঙ্গে আমার আলাপ হয় ডেনমার্কে৷ তিনি (জিওর্জি) গ্রটস্কি-সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাজ করে আসা মানুষ৷ অনেক কিছু জানেন থিয়েটারের ফর্ম আর প্রেজেন্টেশনের ব্যাপারে৷ তাঁর দলের বয়স ৫০ বছরেরও বেশি৷ সেই ১৯৬৪ সালে তিনি নিজের গ্রুপ তৈরি করেছিলেন৷ এমন একজন গুণী থিয়েটার পার্সোনালিটির সঙ্গ আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে৷ আমি খুবই সমৃদ্ধ হয়েছি তাঁর সঙ্গে একটা নাটকের তিনটে শো করে৷ ২০১২ সালে নিজের দল অপস্টো থিয়েট্রো ল্যাবরেটরিও তৈরি করি৷ ক্ল্যারিস লিসপেক্টর-এর 'এস্ট্রেলাস' পরিচালনা করার জন্য জুলিয়াকে আমন্ত্রণ জানাই৷ তিনি রাজি হন৷ সেটা আমার সৌভাগ্য৷' নাটকটির নাম 'এস্ট্রেলাস'৷ এটি পর্তুগিজ শব্দ যার অর্থ 'তারা'৷ 'তারা' শব্দটি অবশ্য ঠিক আকাশের তারা-র অর্থে ব্যবহার করা হয়নি৷ তারা-র অবস্থানের মাধ্যমে মানুষ যেভাবে ভবিষ্যতের কথা জানার চেষ্টা করে, নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য তারা-কে দোষারোপ করে এই 'তারা' সেই তারা৷ এ নাটক এক দুর্ভাগ্যতাড়িত তরুণী ম্যাকাবেয়া-র কথা বলে৷ সে নিজের অবস্থার উন্নতির জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে৷ ওলিম্পিকো নামে এক যুবকের সঙ্গে তার প্রেম হয়৷ কিন্ত্ত টেঁকে না৷ ওলিম্পিকো নিজের অফিসের সহকর্মী গ্লোরিয়া নামে এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে৷ ম্যাকাবেয়া-র দুর্ভাগ্য দেখে গ্লোরিয়া তাকে এক জ্যোতিষীর কাছে পাঠায়৷ জ্যোতিষী ম্যাডাম কারলোটা-র কাছে পাঠায়৷ ম্যাডাম গণনা করে জানান ম্যাকাবেয়া-র সৌভাগ্য আসতে চলেছে শীঘ্রই৷ গণনাকক্ষ থেকে বেরোনোর পরই গাড়ির ধাক্কায় মারা যায় ম্যাকাবেয়া৷ এই নাটকের চারটি চরিত্রেই এক দমে অভিনয় করেন মেরিলিন৷ মুহূর্তের মধ্যে বদলে নেন পরিচ্ছদ৷ পাল্টে ফেলেন বাচনভঙ্গি৷ গত বছর অসমের 'আন্ডার দ্য শাল-ট্রি' ফেস্টিভ্যালে তাঁর এই নাটকটির অভিনয় নজর কেড়েছিল অনেকের৷ এ বছর এসেছেন পশ্চিমবঙ্গে৷ বহরমপুর, রঘুনাথগঞ্জে শো করেছেন৷ থিয়েটার ভিলেজ গোবরডাঙায় নকসা নাট্যগোষ্ঠী আয়োজিত রঙ্গমহোত্সবে এক ফাঁকে কথা বলা গিয়েছে তাঁর সঙ্গে৷ ব্রাজিল কিংবা সামগ্রিক অর্থে লাতিন আমেরিকান দুনিয়ার যে সাম্প্রতিক অবস্থা, যে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, তার কি প্রভাব রয়েছে এ নাটকে? মেরিলিন জানাচ্ছেন, 'দেখুন ও রকম কোনও নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে নাটকটাকে আমরা রাখতে চাইনি৷ এটা এক দুর্ভাগ্যতাড়িত মানুষের গল্প৷ এমন মানুষ তো সারা পৃথিবীতেই আছেন৷ সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি তা সে যে রকমই হোক না কেন, কিছু মানুষের কপাল যেন কিছুতেই ফেরে না! আপনার দেশ, আমার দেশ--- কোথায় নেই বলুন তো৷ তবু আশায় মানুষ বাঁচে!' গোটা নাটকে তিনি একাই অভিনয় করেন সমস্ত চরিত্রে৷ এর কি কোনও বিশেষ সুবিধা রয়েছে? মেরিলিন বলছেন, 'দেখুন সুবিধা অসুবিধা দু'টোই আছে৷ একজন অভিনেতা আর তার লাইট, সাউন্ডের জন্য আর একজন৷ এইটুকু যদি টিমের সাইজ হয়, তবে টু্যর করা বেশ সহজ৷ যাঁরা শোয়ের অর্গানাইজার তাঁদের পক্ষেও সুবিধাজনক৷ মাত্র দু'জনের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে৷' তাহলে এ রকম একক অভিনয়ই কি আগামী দিনের থিয়েটার? মেরিলিন বলছেন, 'না, একক অভিনয় করছি বলে ব্যাপারটার এতটা সরলীকরণও করতে চাই না৷ একদল মানুষ যে পারফরম্যান্স করেন সেটাও তো দেখতে হবে, চালিয়ে যেতে হবে৷ মানছি গ্রুপ থিয়েটারের মধ্যে কিছু গ্রুপ পলিটিক্সও চলে৷ পাশাপাশি, সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যে ইন্টারঅ্যাকশনও কিন্ত্ত আমাদের সমৃদ্ধ করে৷ অর্থাত্ সবকিছুরই ভালো আর মন্দ দু'টো দিকই আছে৷ তাছাড়া আরও কিছু অর্থনৈতিক ব্যাপারও রয়েছে৷' যেমন? 'যেমন ধরুন গ্রান্ট পাওয়ার ব্যাপার৷ একটা বড় দল, যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে কাজ করছেন সেখানে কিন্ত্ত সরকার অনেক সহজে গ্রান্ট দেন, কারণ এতে একবারে অনেকজন থিয়েটারকর্মীর কাজকে সাহায্য করা যাবে৷ একক অভিনেত্রীকে গ্রান্ট পেতে অনেক অপেক্ষা করতে হয়৷' ভারতে দু'বার এলেন৷ এখানকার থিয়েটার দেখেছেন নিশ্চয়ই? 'হ্যাঁ দেখেছি৷ গত বছর অসমে 'আন্ডার দ্য শাল ট্রি ফেস্ট'-এ অনেকগুলো চমত্কার প্রোডাকশন দেখেছিলাম৷ এবারও ভালো নাটক দেখলাম রঘুনাথগঞ্জে, বহরমপুরে এবং এখানে অর্থাত্ গোবরডাঙায়৷ আমি ট্র্যাডিশন্যাল জিনিস থাকলে সেই প্রোডাকশন পছন্দ করি৷ ভারতীয় থিয়েটারে যদি পাশ্চাত্যের ছায়া চলে আসে, বিশ্বাস করুন ভালো লাগে না৷ ভারতীয় সংস্কতি তো খুব সমৃদ্ধ৷ সুতরাং সেদেশের প্রোডাকশনে আমি সেখানকার শিল্পকলাই দেখতে চাই৷ এই প্রসঙ্গে বলে রাখি কথাকলি নাচ আমার খুব প্রিয়৷' যেহেতু তিনি ব্রাজিলের মানুষ, তাই জানতে ইচ্ছে হল, ফুটবল দেখেন নিশ্চয়ই? তাঁর সাফ উত্তর, 'একদম না!' সেকি, কলকাতার মানুষ তো সম্ভবত বিশ্বাসই করবেন না এই উত্তর৷ মেরিলিনের ব্যাখ্যা, 'যখন ছোট ছিলাম, তখন দেখতাম৷ তখন মনে হতো এতগুলো মানুষ একসঙ্গে একটা টিমের হয়ে লড়ছে, এই ব্যাপারটা বেশ লাগতো৷ কিন্ত্ত পরে বড় হয়ে দেখলাম যে ক্লাব টাকা দিচ্ছে তার জন্যই লোকগুলো লড়তে তৈরি৷ অর্থাত্ জার্সিতে কোন নাম লেখা রয়েছে, তার কোনও তাত্পর্য-ই নেই৷ তাছাড়া গোটা বিশ্ব জুড়েই তো খেলার আগেই খেলার ফলাফল ঠিক হয়ে যাচ্ছে৷ ম্যাচ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, খেলোয়াররা ম্যাচ ছেড়ে দিচ্ছে৷ অর্থাত্ ফুটবল মাঠেও একটা নাটকই হচ্ছে৷ তার চেয়ে নিজের নাটক নিয়ে থাকাই তো ভালো!' শীত বিকেলের হলুদ আলো খেলে গেল লাতিন আমেরিকান তরুণীর হাসিতে৷
খড়ির গণ্ডী নাটকের রিভিউ
দীর্ঘ সময় মানে তো ভাই অনন্তকাল নয় ব্রেখট আজও বাঙালির প্রিয়৷ কেন প্রিয়, কেন ভালোলাগে তা দু্যম করে বলে দেওয়া যাবে না৷ কিন্ত্ত একেবারে প্রাণের৷ তাই মিনার্ভা রেপার্টরির অভিনেতাদের নিয়ে অরুণ মুখোপাধ্যায় যখন 'ককেশিয়ান চক সার্কেল' মঞ্চস্থ করতে উদ্যোগী হলেন, নড়েচড়ে বসার কারণ নিশ্চয়ই আছে৷ নাটকটিতে চরিত্র এত বেশি, আর এমন প্লট- সাবপ্লটে বিন্যস্ত যে দক্ষ নাবিক ছাড়া এ জাহাজ চালাতে কেউ সাহসই করবেন না সম্ভবত৷ হুবহু ব্রেখট-এর নাটক নয়৷ আবার খুব আলাদাও নয়৷ দু দলের দ্বন্দ্বে নাটক শুরু৷ একদল যুদ্ধের সময় জমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, অন্যদল পরে সে জমিতে ফসল ফলিয়েছে৷ একটা পালা অভিনীত হয়, যাতে নির্ধারিত হয় জমি কাদের৷ এই পালাতেই গল্পে, ছন্দে, সুরে বর্ণিত হয়েছে এক চৈনিক উপকথা৷ দেশে তখন যুদ্ধ পরিস্থিতি৷ অঙ্গরাজদের চক্রান্তে একদিকে মহারাজ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, অন্যদিকে নগর-কোটালের মুণ্ডু কেটেছেন মোটা রাজপুত্র৷ মহলের রাঁধুনি সুধা৷ প্রহরী শ্যাম তাকে ভালোবাসে৷ শ্যাম তার দায়িত্ব পালন করতে শহর ছেড়ে চলে যায় দূরে৷ কথা দিয়ে যায় ফিরে আসবে শীঘ্রই৷ কোটালবউ নিজেকে বাঁচাতে তার বাচ্চাকে ফেলে পালায়৷ সুধা বাচ্চাটিকে ফেলে যেতে পারে না৷ বহুকষ্টে দাদার বাড়ি পৌঁছায়৷ কিন্ত্ত দাদা তাকে বিয়ে দেয় মড়-মড় ভুষুকের সঙ্গে৷ বিয়ের রাতেই যুদ্ধ থামার খবরে চাঙ্গা ভুষুক৷ তারপর দুটো বছর বাচ্চাটিকে নিয়ে কাটিয়ে দেয় সুধা৷ একদিন নদীতে গিয়ে দেখা হয় শ্যামের সঙ্গে৷ শ্যাম ফিরেছে৷ সুধার বিয়ে হয়ে গিয়েছে শুনে সে খুব অভিমান করে আর ঠিক তখনই হুঁতকো সেপাইরা ধরে নিয়ে যায় সুধার পালিত খোকাকে৷ শহরের আদালতে বিচার হবে কে আসল মা: সুধা নাকি কোটাল বউ? বিচারক আজডাক খড়ির গণ্ডী টেনে দুই মা-কে দু'দিক দিয়ে বাচ্চার হাত ধরে টানতে বলে৷ খোকার ব্যথা লাগবে এই আশঙ্কায় সুধা টানতে পারে না৷ আজডাক জানায় সুধা-ই আসল মা৷ সুধা ফিরে পায় তার বাচ্চাকে৷ শ্যাম ফিরে পায় সুধাকে৷ কাহিনি ও উপকাহিনির চলনে বলনে প্রতিপন্ন হয় শিশু আর জমির ওপর তার অধিকারই বর্তায়, যে তাকে লালন করে৷ উল্লেখ করা দরকার ব্রেখটের নাটকটিকে আশ্রয় করে এই নাটক মঞ্চস্থ করলেও মূল নাট্যপাঠকে বিশ্বস্তভাবে মেনে চলার চেষ্টা চোখে পড়েছে৷ সমসাময়িকতা ফুটিয়ে তোলার জন্য কিছু ইম্পোজ করা হয়নি৷ সেটা করতে গেলে কিন্ত্ত নাটকের উপকথার মেজাজটাই নষ্ট হয়ে যেত হয়তো৷ নাটকের রাজনৈতিক বার্তা দর্শকরা খুঁজে নেবেন৷ 'ক্ষমতায় ভরসা রাখলে টেকে তা দীর্ঘ সময়, দীর্ঘসময় মানে তো ভাই অনন্তকাল কখনও নয়', 'ভালো হওয়ার লোভ যে কী সাংঘাতিক' কিংবা 'ভাঙলে বড়লোকের প্রাসাদ ছোটলোকই বেশি মরে'-র মতো কথায় তো ব্রেখট স্পষ্ট৷ অরুণবাবু তো বটেই তাঁর সহযোগী সঙ্গীতা, অমিত, শুভঙ্করের প্রয়াসও প্রশংসনীয়৷ আলাদা করে সুধার চরিত্রে সুপর্ণা-কে ভালো লাগে৷ কিন্ত্ত গোটা প্রোডাকশনে দলগত গান, নাচ-এ আরেকটু এনার্জি-র যেন প্রয়োজন ছিল৷ তবু একবার দেখতেই হবে৷ - ইন্দ্রনীল শুক্লা
ছান্দিক ৫০
কেন্দ্রীয় চরিত্র আবহ মাঝে মাঝেই ‘আমি মেরে ফেলেছি , আমি মেরে ফেলেছি ’ বলে চিত্কার করে৷ আর সেটার সঙ্গেই জুড়ে আছে নাটকের প্রাণ৷ ক্রমে ক্রমে নাটক যেভাবে এগিয়ে চলে তাতে আমরা বুঝতে পারি কোন পরিস্থিতির কারণে ছেলেটি , যে কীনা একসময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র সংগ্রামের ভূমিকা ’-র উপর গবেষণা করতে চেয়েছিল , সে অমন মানসিক বেসামাল হয়ে পড়েছে৷ জানা যায় সে কয়েকটি মৃত্যু , দুর্ঘটনার সাক্ষী৷ আর প্রতিবারই এমন সাক্ষী থাকার কারণেই সে মনে মনে নিজেকে বসিয়ে ফেলেছে ঘাতকের জায়গায়৷
সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে তার মনের অস্বাভাবিকতা৷ যেসব মৃত্যু , খুন আমাদের আশেপাশে ঘটে তার সব ক’টির কারণই কি আমরা জানি ? তা কিন্ত্ত নয়৷ যে মৃত্যু স্বাভাবিক তাতে হয়তো অস্বাভাবিকতা আছে , যে মানুষকে নিরপরাধ বলে মনে হচ্ছে তিনিই হয়তো অপরাধী!গল্পের চেয়েও বড় সত্য আছে বাস্তবে৷ তেমন আবর্তেই পৌঁছে দেয় নাটকটি৷ -ইন্দ্রনীল শুক্লা৷
খুন , ট্রমা , ‘ধ্বজ ’ আর অটো
রচনা , নির্দেশনা : নবারুণ ভট্টাচার্য আশ্রয়ে কৌশিক কর
দল : কলকাতা রঙ্গিলা
অভিনয় : কৌশিক , সত্রাজিত্ , গম্ভীরা , তন্বিষ্ঠা , অভিরূপ , পলাশ , সমীরণ
ইন্দ্রনীল শুক্লা
প্রান্তিক মানুষ , অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের কথা আর তাঁর মতো করে কে বলতে পারেন ? তাই নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্প যখন মঞ্চে আসে , তখন কানট্রি স্পিরিটের ঝাঁঝ যেন গায়ে এসে লাগে৷ এর আগে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় বা সুমন মুখোপাধ্যায় যখন ‘ফ্যাতাড়ু ’দের মঞ্চে এনেছেন , মুগ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে৷ নতুন প্রজন্মের অভিনেতা , পরিচালকরাও কিন্ত্ত নবারুণে আকৃষ্ট৷ আর তারই সাম্প্রতিকতম উদাহরণ কৌশিক কর -এর ‘অটো ’৷
এ এক অটোচালকের গল্প৷ যাদের গাড়িতে আমরা রোজই চড়ি৷ কিন্ত্ত যা জানি না , জানতে চাইও না , তার জীবনের সমস্যা কি কি ? সে কোন বস্তিতে থাকে ? সেই বস্তিতে তার ঘরের ঠিক পাশেই একটা ড্রেন আছে কিনা ? সে ড্রেন থেকে মশার কামড়ে তার জ্বর হয় কিনা ? হলে ওষুধ কেনার পয়সা জোটে কিনা ? বস্তিতে তার বৌ সম্মান নিয়ে চলতে পারে কিনা ? বৌ পালানোর ঘটনা সেখানে হামেশাই কিনা ? মালিক কেমন পয়সা -কড়ি দেয় ? অসুস্থ হলে চিকিত্সা হয় কেমন করে ? রাজনীতির হ্যানা -ত্যানা হ্যাপা কেমন করে তারা পোহায় ? ইত্যাদি ইত্যাদি৷ প্রশ্ন প্রচুর৷ এবং উত্তর নিয়ে আমরা ‘বদার্ড’-ই নই৷ স্রেফ অটোয় চেপে মেট্রো অবধি পৌঁছে যেতে পারলেই শেষ৷
এই হল প্রেক্ষাপট৷ কিন্ত্ত সেখানেই আচমকা এক খুন৷ দলাদলি বললে দলাদলি , বখড়ার ঝামেলা বললে তাই , কিংবা ব্যাপারটা স্রেফ চেপে যেতে চাইলে ‘পলিটিক্যাল ক্যাঁচাল ’ বলেও দিব্যি চালানো চলে৷ কিন্ত্ত তার বাইরে আরও একটা জায়গা৷ মন ! সে জায়গায় ছাপ পড়লে অতি শক্ত মানুষও শিথিল৷ জ্বর গায়েও বাড়ির জন্য দুটো পয়সা আনতে রাস্তায় বেরিয়ে আস্ত একটা খুনের সাক্ষী হয় এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সেই অটোওলা৷ সে আহত হয় না , তাকে পুলিশ ধরে না , গুন্ডারা পেটায় না৷ কিন্ত্ত তার মন থেকে সরে যায় না সেই বীভত্স খুন৷ উদোম মারের চোটে ছিন্ন -বিচ্ছিন্ন হয়ে মারা যাওয়া একজনের মৃত্যুযন্ত্রণা অটোওলাকে সন্ত্রস্ত করে দেয়৷ (এই দৃশ্যে লাইভ স্লো -মোশন এবং লাল আলোর ব্যবহার একটা বীভত্সতার জন্ম দেয় , যা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল৷ কারণ , এই দৃশ্যটাই নাটকের কেন্দ্রবিন্দু৷) এই ঘটনার ট্রমা অটোওলার মধ্যে লিঙ্গশৈথিল্য এনে দেয়৷ একে একে সবই খুইয়ে ফেলে সে৷ বৌ পালিয়ে যায় , অটো চালানো থেমে যায়৷
সাম্প্রতিক সময়ে কৌশিক যে রকম একটা ম্যানারিজম -এ নিজের অভিনয় নিয়ে ফেলছিলেন , তার থেকে তিনি শেষ অবধি নিজেকে বের করতে পেরেছেন দেখে ভালো লাগবে৷ তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করে গিয়েছেন স্ত্রী -র ভূমিকায় তন্বিষ্ঠা , পাইস হোটেলের মালিকের ভূমিকায় থাকা সত্রাজিত্ , পার্টি-আশ্রিত গুন্ডার রোলে থাকা গম্ভীরা৷ একজন অটোচালকের জীবন এভাবে চোখের সামনে দেখতে পারা কিন্ত্ত একটা নিদারুণ অভিজ্ঞতা৷ আর শেষে বলা দরকার , এই নাটকে স্বয়ং অটোটিও কিন্ত্ত একটি চরিত্র -বিশেষ৷ সেই অটোর ঘন নিঃশ্বাস আর তীব্র জ্বালানি নিঃসরণের শব্দেই নাটক শুরু হয়৷ আবার রুটে যাতায়াত বন্ধ হয়েও অটোর মুখোমুখি বসে থাকে তার চালক৷ দু’জনেরই যে মন খারাপ !
পাঁচ দিনের নাট্যোৎসব
কলকাতার শহরতলী তথা মফসসল এলাকায় বেশ কিছু থিয়েটার উৎসব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে গত কয়েক বছরে৷ তার মধ্যে অন্যতম ডানকুনি থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল , যার আয়োজক থিয়েটর শাইন নাট্যদল৷ জেলার দল , অন্য রাজ্যের দল তাদের উৎসবে জায়গা করে নিয়েছে৷ এবারও তার ব্যতিক্রম নেই৷ উৎসব শুরু হচ্ছে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে৷ চলবে ২০ তারিখ পর্যন্ত৷ পাঁচ দিনের এই উৎসবে মোট আটটি নাটক দেখার সুযোগ মিলবে৷
উৎসবের শুরুতেই থাকছে দক্ষিণ আমেরিকার মান্দাগোরা সারকো নাট্যগোষ্ঠীর নাটক ‘মান্দ্রাগোরা সার্কাস ’, যার পরিচালনায় মারিয়ানা সিলভা৷
থাকছে ওডিশার নায়িকা নাট্যদলের ‘রেবতী এবতি সেবতি ’,যার পরিচালনায় সুজাতা প্রিয়ংবদা৷ ক্রমে বঙ্গ দলের মধ্যে দেখা যাবে প্রবীর গুহ -র পরিচালনায় অল্টারনেটিভ লিভিং থিয়েটার -এর ‘তিতাস একটি নদীর নাম ’ এবং প্রকাশ ভট্টাচার্যের পরিচালনায় নান্দীপট দলের ‘বল্লভপুরের রূপকথা ’৷
ভিন রাজ্যের নাটকগুলির মধ্যে থাকছে রেখা সাসোদিয়া -র পরিচালনায় রাজস্থানের নাট্যাংশ গোষ্ঠীর নাটক ‘দুলহন এক পাহাড় কি ’ (সঙ্গের ছবি ) এবং অজয় মেচ -এর পরিচালনায় অসমের রেপ্লিকা গোষ্ঠীর নাটক ‘বেদবাগ ’৷ দেখা যাবে শুভজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় শিল্পীমন গোষ্ঠীর ‘লারনিং ফ্রম দি বারনিং ঘাট ’৷ রয়েছে দিল্লির ভাবরস রঙ্গভূমি প্রযোজিত , সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মরণপ্রান্ত ’৷
নাটকের পাশাপাশি থাকছে গানের অনুষ্ঠান৷ বসবে আলোচনা সভা৷ আলোচনার বিষয় ‘শিশুর বেড়ে ওঠায় থিয়েটারের ভূমিকা ’৷ উত্সবের অন্যতম কর্ণধার শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশা অন্যান্যবারের মতো এবারও উৎসবকে সফল করবেন নাট্যমোদী মানুষ৷
পিএফ-এর দাবিতে প্রথম আন্দোলন
এমিল জোলার উপন্যাস ‘জার্মিনাল ’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘বোল ’ নাটক৷ কিন্ত্ত সে উপন্যাস তো রোম্যান্টিক কাহিনি নয়৷ তাতে ছিল প্রভিডেন্ড ফান্ড -এর দাবিতে পৃথিবীর প্রথম আন্দোলন৷ ছিল খনি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে গর্জে ওঠা৷ সমস্যাগুলো আজও আছে৷ তাই প্রয়োজন আছে জোলাকেও৷ তবে মূল নাটকের আলোচনার আগে উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট একবার সংক্ষেপে দেখে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন৷ ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের ‘অরিজিন অফ দ্য স্পিসিস ’ বইটি প্রকাশের পর ইউরোপের নাট্যজগত্ থেকে বহুদূরে প্রকৃতিবিদদের নিভৃত জনবিরল জগতে ঘটে গেল এক প্রচণ্ড আলোড়ন৷ এই তত্ত্ব দেবভক্ত মানুষের কল্পনাকে চুরমার করে দিল৷ আবার ওই একই বছরে প্রকাশিত হয়েছিল কার্ল মার্কস -এর ‘ক্রিটিক অফ দ্য পলিটিক্যাল ইকনমি ’৷
পরে ‘দাস ক্যাপিটাল ’৷ এই বই দুটো পড়ার পর মানুষ আর আগেকার ধারণায় ফিরে যেতে পারেনি৷ এভাবেই কিন্ত্ত সাহিত্যে জন্ম নিয়েছিল বাস্তবতাবাদ৷ আর এই বাস্তবতারই সন্ধানে পরীক্ষাধর্মী উপন্যাসের ভাবনায় এমিল জোলা সৃষ্টি করেন ‘জার্মিনাল ’৷
উপন্যাসের এই প্রেক্ষাপটকে আগলে ধরে রেখেই গড়া হয়েছে ‘বোল ’৷ উপন্যাসটিতে পৃথিবী নিজেই এক শক্তিশালী চরিত্র৷ যার উপরিভাগে চোখ জুড়িয়ে দেওয়া প্রকৃতিক সৌন্দর্য আর নিচে কয়লা খাদানের ভয়ঙ্কর অন্ধকার৷ ফরাসী যুদ্ধগীতি ‘লা মার্শেইয়েজ ’, যা তৃতীয় নেপোলিয়নের জমানায় নিষিদ্ধ ছিল , সেটাই নাটকের থিম সং হিসেবে ব্যবহার করেছেন নির্দেশক৷ ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে জনতা যখন ‘রুটি রুটি ’ করে চিত্কার করছিল তখন সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন ছিলেন মৌন৷ সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য জোলাকে ভীষণ আঘাত করেছিল৷ ‘মোঁসু’ কোলিয়ারিতে যখন বিপ্লবের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছে তখন ফ্রান্সের আরক্ষা বাহিনী এসে হাজির হয়৷ নাটকের প্রধান চরিত্র এতিয়েন তখন খনির মজুরদের সংগঠিত করে বিশ্বে প্রথমবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের আন্দোলনের ডাক দেয়৷ ন্যাশনাল গার্ডরা গুলি চালাতে রাজি ছিল না৷ কিন্ত্ত খনি মজুররা তাদের উপর ইঁট -পাটকেল ছোড়া শুরু করে৷ ফলে নির্দেশ আসে ‘ফায়ার ’!
হত্যালীলা সংঘটিত হয়৷ এটা ছিল সত্য ঘটনা৷ আর জোলার উপন্যাস আশ্রিত এই নাটকে কয়লা খনির মালিক (সুভারিন )-এর সাহায্যে খনির মধ্যে জল ঢুকিয়ে বিপ্লবের নেতৃস্থানীয়দের মেরে ফেলার চেষ্টা করে৷ বেশ কিছু মজুর মারা যান৷ এতিয়েন বেঁচে যায়৷ মালিকপক্ষ তখন সমস্ত দোষ এতিয়েনের ঘাড়েই চাপায় এবং তাকে মোঁসু কোলিয়ারি ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়৷ শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়৷ কিন্ত্ত বিপ্লবের প্রথম চারাগাছটির রোপণ ঘটে যায়৷ এখানে ‘আয়েগা আয়েগা ’ গানটি ব্যবহূত হয়েছে মাউথ অর্গানে৷ এই সুরের সঙ্গে সঙ্গেই হাত নেড়ে শ্রমিতকদের কাছ থেকে দর্শকের মাঝখান দিয়ে দূরে চলে যেতে থাকে এতিয়েন৷ শ্রমিকরা তখন সার্চলাইট ফেলে দর্শকের মধ্যেই খুঁজছে এতিয়েনকে৷ চমত্কার এক দৃশ্য৷
‘জার্মিনাল ’ উপন্যাসে জোলা কখনও ভবিষ্যতে বিপ্লবের রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য নিজেকে বাজি ধরেননি৷ বিপ্লবটা ১৭৮৯ -এ শুরু হয়ে এখনও পর্যন্ত একটা অসমান্ত সংগ্রাম হিসেবে বহমান প্রক্রিয়ার মতো বেঁচে থাকবে , এমনই ইঙ্গিত জোলার উপন্যাসে আছে৷ ‘বোল ’ নাটকে দেখানো হচ্ছে পৃথিবীর সাথে মানুষের ভালোবাসা আর ঘৃণায় মাখামাখি সম্পর্কের বাস্তবতা৷ ১৮৮৫ সালে জোলার এই উপন্যাস প্রকাশের সময় এমনই বার্তা ছিল৷ এতিয়েনের ভূমিকায় চমত্কার অভিনয় করলেন দীপা ব্রহ্ম৷ শৌভিক (মায়োদ ), অভীক (হানবো ), প্রিয়েন্দু (বন্মর )-এর অভিনয়ও টানটান রাখবে দর্শকদের৷ পরিচালক আশিস চট্টোপাধ্যায় এর আগেও বিদেশি সাহিত্য নিয়ে সফলভাবে কাজ করেছেন৷ মার্কেজ -এর ‘কর্নেল ’কে মঞ্চ থেকে তিনিই তো প্রথম চিঠি লিখেছিলেন ! শার্লক হোমসও মঞ্চে ঘুরে গিয়েছেন তাঁর উপস্থাপনায়৷ আর এবার তিনি সফলভাবে নিয়ে এলেন এমিল জোলাকে৷ কলকাতার বহু দল যেখানে এন্টারটেইনমেন্ট মাথায় রেখেই একের পর এক নাটক করে চলেছে , সেখানে গোবরডাঙায় বসে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই আশ্রিত জোলার উপন্যাস নিয়ে কাজ করা অবশ্যই প্রশংসনীয়৷ এ কাজ যে গবেষণাঋদ্ধ , তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ খনিতে মাথায় আলো বেঁধে ঘনান্ধকারে নামতে থাকা শ্রমিকরা , আচমকা লিফট উঠে আসা , কিংবা খনিতে জল ঢুকে যাওয়ার ভয়ানক দৃশ্যগুলো হন্ট করবেই৷ শ্রমিকের অনিশ্চতার অন্ধকার তো ফুরোয় না , তাই বিপ্লবও ফুরনোর নয় !
গুজবের মঞ্চে যখন এলোমেলো 'প্রলাপ
একনিষ্ঠ থিয়েটারের মন নিয়ে আপনি প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত হয়েছেন। নির্দেশ মত নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন আপনার সাধের মুঠোফোনটিও। কিন্তু একি! তামাশা হচ্ছে নাকি। রীতিমত টিকিট কেটে থিয়েটার দেখতে এসেছেন।
ভাষার ব্যবহার মোটেই সংযত নয়। নাটক চলাকালীন পরিচালক ঢুকে পড়ছেন স্টেজে। চলে আসছে অন্য নাটকের দৃশ্য। আলো, মিউজিক সব ঘেঁটে ঘ। রিহার্সালের বড়ই অভাব। গুজবের 'প্রলাপ' দেখলে আপনার উপলব্ধি খানিকটা এ রকম হবে। চিনেবাদাম চিবোতে চিবোতে অথবা এক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। দেখবেন আপনার জীবন মোটেই সোজা পথে চলছে না। সে আপনি যতই আগে ভাগে রিহার্সাল করে বেরোন না কেন। ঠিক কিছু না কিছু ঘোটালা হয়েই থাকে।
নাটকটির মূল রচনা বাদল সরকারের। সেখান থেকে ভাবনা নিয়ে নিজের মত 'প্রলাপ' বকেছেন বিশ্বাবসু। এই নাটকের নির্দেশনা এবং সম্পাদনা তাঁর। আবহ নির্মাণে স্বস্তিক, শুভব্রত। অভিনয়ে রয়েছে উদ্দালক, সাম্য, তিস্তা, অর্কজা, সৌরভ এবং নিলয়। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি অষ্টম পর্যাস ফেস্টিভ্যালে জ্ঞানমঞ্চে মঞ্চস্থ হবে প্রলাপ। এটি প্রলাপের ষষ্ঠ শো।
আসুন। দেখুন। গুজবে কান না দিয়ে চূড়ান্ত ঝামেলা করুন। সাতটি নাটক মঞ্চস্থ হবে এদিন। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম নাটক প্রলাপ।
ব্রাত্য-দেবশঙ্করের হাত ধরে শহরে শুরু নাট্যোত্সব
গুরু-শিষ্য মেলবন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মকে থিয়েটারমুখী করার উদ্দেশে শুরু হল নাট্য উত্সব। চার দিন ধরে মঞ্চে নবীন প্রজন্মের সঙ্গে সেতুবন্ধনে প্রয়াসী নাট্য জগতের পোড়খাওয়া ব্যক্তিত্বরা।
গত ১৫ বছর ধরে কলকাতায় থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করে চলেছে ভোডাফোন। বৃহস্পতিবার মিনার্ভা থিয়েটারে সূচনা হল চলতি বছরের নাট্য উত্সবের। অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন কলেজের নাট্যপ্রেমী পড়ুয়ারা। এদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার তথা রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং দেবশঙ্কর হালদার। ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায় দেখানো হবে ২১ গ্রামস, মুম্বই নাইটস এবং মলুয়া নাটকটি। অনুষ্ঠানের শেষদিন অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারি দেখানো হবে শরমন জোশির বিখ্যাত নাটক ম্যায় অউর তুম।
কল্লোলিনী তিলোত্তমা যে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক এবং বাহক তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এই প্রজন্ম বাংলা থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক নয়, এ প্রবাদ মিথ্যে বলে প্রমাণিত হবে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে তরুণ তুর্কিদের ভিড় দেখলে।
২০০১ সালে ভোডাফোন যখন প্রথম থিয়েটারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে তখন থেকেই পাশে পেয়েছে থিয়েটার জগতের গুনীজনদের। এগিয়ে আসুন আপনারাও। হৈ হৈ করে এগিয়ে চলুক বাংলা নাটক, তার আপন পথ বেয়ে।
সিনেমাকে গোল দিল এ নাটক
নাটক : গয়নার বাক্স
রচনা , নির্দেশনা : পার্থপ্রতিম দেব
দল : বাঘাযতীন আলাপ
অভিনয় : সোহিনী , রূপা , উদিতা , শিপ্রা , অনিন্দিতা , পূরবী , তিথি , কৃষ্ণা , জয়শ্রী
সেটা ১৯৯৩ সাল৷ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘গয়নার বাক্স ’ উপন্যাস৷ তা থেকে সিনেমা তো আগেই তৈরি হয়েছে৷ এবার তৈরি হল নাটক -ও৷ পার্থপ্রতিমের থেকেই জানা গিয়েছে তিনি কিন্ত এ কাহিনিকে মঞ্চে উপস্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেক আগে৷ তিনি নাটকের চেহারাটা খাড়া করে ফেলেছিলেন সেই ১৯৯৬ সালেই৷ অতএব সেদিক দিয়ে দেখলে প্রায় দু’দশক পর তাঁর স্বপ্নপূরণ ঘটল৷ সময় অনেকখানি বয়ে গেলে কি ভাবনায় ভাটা পড়ে যায় ? হয়তো নয়৷ বরং মনে লালন -পালন করতে করতে তা আরও রসে জারিত হয়৷ কেমন সে জারণ সে আলোচনায় প্রবেশের আগে নাটকে কাহিনিটি যে চেহারায় রয়েছে তা একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক৷
সাত বছরে বিয়ে আর বারো বছরে বিধবা ! অতএব , একশো ভরি গয়না নিয়ে পিসিমা ফিরে এলেন পড়তি বনেদি মিত্রচৌধুরী পরিবারে৷ একে বাল্যবিধবা , তায় আবার একশো ভরি গয়না৷ দেখতে দেখতে একসময়ে তিনিই বাড়ির সর্বময় কর্ত্রী হয়ে উঠলেন৷ একাত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধ হলেও তাঁর গায়ের রঙ , চাল -চলন দেখে আন্দাজ করা যায় যে একসময়ে বহু পুরুষ তাঁর জন্য পাগল ছিলেন৷ মারা যাওয়ার ঠিক আগে তিনি গয়নার বাক্স দিয়েগেলেন ছোটবউ সোমলতার হাতে (আগে দিলেন নাকি পরে সেটা অবশ্য সোমলতার গুলিয়ে গিয়েছে )! পিসিমার থেকে সোমলতা যা শিখতে পেরেছে তা হল একজন মহিলা যদি সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে চান তবে চাই শক্তপোক্ত একটা আইডেন্টিটি , চাই অর্থনৈতিক শক্তির অংশীদারিত্ব৷ সেজন্যই পিসিমা বেছে নিয়েছিলেন গয়নার বাক্স -কে৷ এই বাক্সটার জোরেই তিনি পঁচিশ বছর ধরে কার্যত সংসারের মাথা হয়ে বেঁচে থাকতে পেরেছেন৷ আর সেই শিক্ষাই ক্রমে চারিত হয় সোমলতা -র মধ্যে৷
অর্থাৎ ঘটনাটি আপাতভাবে এক কমেডি হলেও মূলগতভাবে এটি আমাদের সমাজের এক দুঃখজনক দিকের উপরেই আলো ফেলে৷ পার্থপ্রতিম -এর সাম্প্রতিক কাজের মধ্যে নান্দীকারের ব্যানারে ‘নাচনি ’ কিংবা ‘পাঞ্চজন্য ’ মানুষ পছন্দ করেছেন৷ কিন্ত যা আলাদা করে বলা দরকার তা হল এই নাটকের ক্ষেত্রে তিনি গ্রুপ থিয়েটারি যে নিজস্ব প্যাটার্ন সেটা থেকে নিজেকে অনেকখানি সরিয়ে নিয়ে এসেছেন প্রয়োগে বা আঙ্গিকে৷ প্রোডাকশনটি উস্কে দিতে পারে একসময়ের হাতিবাগান পাড়ার বোর্ড থিয়েটারের স্মৃতি৷ কোনও বক্তব্য বা নীতিকথা আলাদা করে তুলে আনার কোনও অহেতুক তাগিদ দেখাননি পরিচালক৷
তিনি আলাদা করে নাটকে নারীবাদী কথা বলে নাটককে ভারাক্রান্ত করেননি৷ কিন্ত গোটা নাটকে কোনও পুরুষ অভিনেতা নেই৷ বেশ বিস্ময়ের৷ তবে নাটকের গতিটাও এতোই চমৎকার যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপারটা চোখেই পড়বে না৷ পিসিমার ভূমিকায় সোহিনী সেনগুন্ত তো বটেই বাকিরাও প্রত্যেকে মাত করে দিলেন গতিময় অভিনয়ে৷ স্টেজক্রাফটও আলাদা করে বলার মতো৷ ভৌতিক রূপে পিসিমার আগমন প্রতিবার বেশ শিহরণ জাগিয়েছে দর্শকের মধ্যে৷ কিন্ত শীর্ষেন্দু-র ভূতের যে নিজস্ব মজা অর্থাৎ ভূত এলেও সে তেমন কোনও ‘ফ্যাটাল ’ ক্ষতি করবে না এই আশ্বাস মিলেছে নাটকেও৷ সম্পূর্ণ এক অন্য সোহিনীকে আবিষ্কার করা গিয়েছে এই নাটকে৷ মাঝে মাঝে তিনি যখন স্টেজের একেবারে সামনে এসে পড়েন , মনে হয় যেন দর্শকের সঙ্গে ভূত সরাসরি ইন্টারঅ্যাক্ট করছে , তাদের সঙ্গে মনের কথা শেয়ার করছে৷ অনবদ্য ! এপাশ ওপাশ দেখে নিয়ে একটা কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো , সিনেমাটিকে বেশ কয়েকখানা গোল দিয়েছে এ নাটক৷ তার কারণ সম্ভবত সারল্য৷ শীর্ষেন্দুর গল্পটির মূল কাঠামো থেকে সরে অন্য কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করার বা অহেতুক সমসাময়িক হয়ে ওঠার কোনও প্রয়াস ছিল না নাটকে৷ তাই নির্মল আনন্দ জয় করেছে মনকে৷
দশ বছর পর হয়তো ব্রাত্য আর আমি আড্ডা মারব
দেবেশ চট্টোপাধ্যায় আপাতত ব্যস্ত৷ তাঁর দল সংসৃতির ২৫ বছর হল৷ চলতি সপ্তাহান্তে অ্যাকাডেমিতে তারই উদযাপন উৎসব৷ ব্যস্ততার এক ফাঁকে বসে কথা শুরু করা গেল এ নাটক নিয়েই৷ ক্রমে প্রবেশ অন্যান্য প্রসঙ্গেও৷
নতুন নাটক
‘চাঁদ মনসার কিস্্সা ’ শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সংসৃতির নতুন নাটক৷ আমার মনে হয় এক গুরুর আন্ডারে কাজ করার চেয়ে মাঝে মাঝে একটু গুরু বদলে যাওয়া ভালো৷ এই নাটকটা আগে ব্লাইন্ড অপেরাতে হয়েছে৷ তখন শুভাশিস ব্লাইন্ডদের নিয়ে করেছে৷ এবার আমাদের দলে৷ গান করেছেন অভিজিৎ বসু৷ তরুণ প্রধান কোরিওগ্রাফ করেছেন৷ ছৌ -য়ের বিশেষ ট্রেনিংও হয়েছে দলে৷ বাদকরা কিন্ত ব্লাইন্ড অপেরার সদস্য , যাঁরা চোখে দেখেন না৷ আবার , কনটেন্টওয়াইজ এটা শুধুমাত্র মনসামঙ্গল নয়৷ ধর্ম নিয়ে যে চারপাশে এতকিছু ঘটছে, ধর্ম নিয়ে যে পক্ষ তৈরি হয় , তাদের হার -জিত হতে থাকে , এই খেলাটা যে আমাদের দেশে অনবরত চলছে সেটা অ্যাড্রেস করা দরকার ছিল৷ তাই শুধু মঙ্গলকাব্যের মতো নয়৷ এর মধ্যে দুটো ভাঁড়ের চরিত্র আছে , যারা অনবরত সময়টাকে ধরে ক্রিটিসাইজ করতে করতে যায়৷ বেহুলা যখন ভেসে যাচ্ছে তখন কেউ ওকে বলছে না যে যাওয়ার দরকার নেই , বা কেউ ওকে তেমন হেল্পও করে না৷ এদিকে এত কাণ্ড করে সে যে স্বামীকে বাঁচায় সেই স্বামী প্রথম প্রশ্ন করে যে বেহুলা সতী কিনা , সেটা প্রমাণ দিতে হবে৷ আজও কিন্ত মেয়েরা এ রকম নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে৷ সে দেরি করে বাড়ি ফিরলে তাকে প্রশ্ন করা হয় , যাবতীয় এথিকস তাকেই ধরে রাখতে হয়৷ এদিক দিয়ে এই মঙ্গলকাব্য কোথাও যেন কনটেম্পোরারি৷ প্রশ্ন হল , মনসামঙ্গল কার ? চাঁদের সম্মান প্রতিষ্ঠার গল্প ? নিম্নবর্গীয় দেবী হিসেবে মনসার লড়াইয়ের কাহিনি ? না বেহুলার একক সংগ্রামের গল্প ?’
নতুন ছবি
‘পিটার বিক্সেল -এর গল্প থেকে আগেই ‘ইয়ে ’ নাটক করেছিলাম৷ নাটকে একজন প্রোটাগনিস্ট ছিল৷ কিন্ত ফিল্মের স্ক্রিপ্ট করার সময় তিন ভাগে ভেঙে দিলাম৷ একটা লোক যে কলকাতা শহরের সিঁড়ি গোনে , এই রোলটা নিত্য গাঙ্গুলি করেন৷ অর্পিতা ঘোষ আবার এমন একজনের ভূমিকায় অভিনয় করছে , যে কীনা নিজের একটা ভাষা খোঁজে৷ সে আশপাশের ভাষায় কথা বলবে না৷ দেবশংকর হালদার একজন দেশ আবিষ্কারক , যিনি বাগবাজার , শ্যামবাজার এগুলো আবিষ্কার করেন৷ আমেরিকায় বিশ্ব ভ্যাগাবন্ড সম্মেলনে যাওয়ার জন্যও ডাক পান৷ কিন্ত পরে জানতে পারেন আমেরিকা বলে কোনও দেশ নেই৷ ভারতবর্ষ বলেও কোনও দেশ নেই৷ অর্থাৎ তিনজন , যাদের একজনের নিজস্ব সংখ্যা ছিল , একজনের নিজস্ব ভাষা ছিল , আরেকজনের নিজস্ব দেশ ছিল ! প্রত্যেকেই নিজস্ব জিনিস হারায়৷ এবং পাওয়ার তাদের কাছে জানতে চায় , কেন তুমি নতুন কিছু জানতে চাইছ ?!’
বার্লিনে
‘বার্লিনের ইউরোপিয় ফিল্ম মার্কেটে আমার পরিচালিত ‘ইয়ে ’ ছবিটা গিয়েছিল৷ এটা প্রতিযোগিতামূলক বিভাগ নয়৷ জুরি সিলেকশন নয়৷ একটা ইন্দো -জার্মান সংস্থা আমার ছবির প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিল৷ তারাই ছবিটাকে ওখানে দেখায়৷ বার্লিনে যাওয়ার আরেক উদ্দেশ্য ছিল গল্পকার পিটার বিক্সেলকে খোঁজা৷ ওঁর নব্বইয়ের উপর বয়স৷ কোথায় থাকেন কেউ জানে না৷ অ্যাক্সিডেন্টালি আমার ছবি দেখতে আসেন দুই ভদ্রলোক , তাঁরা বিক্সেলের বাড়ির কাছে থাকেন৷ তাঁরা জানান পিটার বিক্সেলের গল্প নিয়ে কলকাতার একজন ছবি বানিয়েছেন , এটা শুনেই তাঁরা ছবিটা দেখতে এসেছেন৷ তাঁরা খুব উত্তেজিত৷ আমি ওঁদের জানাই জার্মানি থেকে কলকাতায় যে এই গল্পের জার্নিটা ঘটেছে সেই তথ্যটা যেন কোনও ভাবে বিক্সেলকে জানানো হয়৷ বার্লিনে গিয়ে ব্রেখটের যে দল , বার্লিন অনসম্বল -এ গিয়েছিলাম৷ গুন্টার গ্রাস -এর ‘দ্য টিনড্রাম ’ প্রোডাকশন নিয়ে কাজ হচ্ছিল৷ দু’জন সিনোগ্রাফারের সঙ্গে আলাপ হল৷ ওদের কাজের পদ্ধতি জানলাম৷ ’
আড়াই দশক
‘দলের ২৫ বছর মানে হল আমার গোবরডাঙা থেকে কলকাতা আসার ২৫ বছর৷ শহুরে থিয়েটারের জার্নি আর কলকাতায় আসাটা মিলেমিশে রয়েছে৷ অনেক বন্ধুত্বেরও ২৫ বছর পূর্ণ হল৷ দলের এই যাত্রায় বিচ্ছেদ হিসেবে কিছু মনে রাখতে চাই না৷ আমি বন্ধুত্ব হিসেবেই মনে রাখব৷ আমি কোনও দিন কোনও সম্পর্ককে বিচ্ছেদের জায়গা থেকে মনে রাখি না৷ মনে করি ওটা একটা এক্সটেনশন অফ বন্ধুত্ব৷ বন্ধুত্বেরই একটা বড় পরিসর , যা আমি হয়তো পুরোটা ছুঁতে পারিনি , কিন্ত কোনও না কোনও দিন ঠিক ছুঁতে পারব৷ হ্যাঁ, দুঃখও আছে অবশ্যই৷ দলের ২৫ বছরে পুরনো কিছু নাটক করার ইচ্ছে ছিল , যেমন ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল ’৷ কিন্ত করতে পারলাম না !’
প্রসঙ্গ কস্তরী
‘আজকে সংসৃতি যে সংসৃতি হয়েছে , তার পিছনে অনেকটাই ভূমিকা লালী -র (কস্তরী চট্টোপাধ্যায় )৷ আমি ক্রিয়েটিভ জায়গা থেকে কাজ করেছি , কিন্ত মূলত দলটা চালিয়েছে লালী৷ তার অবদান আমি কখনও অস্বীকার করতে পারব না৷ তাই আমি সবসময়েই চাই যে পারস্পরিক সম্মানটা যেন থাকে , ভালোবাসাটুকু যেন থাকে৷ আমাদের যে ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে তাতে লালীর অভিনীত নাটকের ছবিও ডিসপ্লেতে রাখা আছে যত্নে৷ ফিজিক্যালি না থাকতে পারলেও আমি মনে করি লালী মানসিকভাবে দলের ২৫ বছরের উৎসবের সঙ্গে আছে৷ ’ ব্রাত্য প্রসঙ্গ‘একই কথা ব্রাত্য -র ক্ষেত্রেও বলার যে , আমার সঙ্গে ব্রাত্য -র সম্পর্ক কোনও দিন নষ্ট হবে না৷ বিশ্বাস করি , যদি বেঁচে থাকি , হয়তো আরও দশ বছর পর আমরা বসে আবার আড্ডা মারব এবং মারবই৷ আমি শিওর এ ব্যাপারে৷ কারণ , আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনও খাদ ছিল না৷ আমাদের যখন বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তখন ব্রাত্য বসুর ক্ষমতা ছিল না৷ তখন ব্রাত্য ছিল , দেবেশ ছিল৷ যেহেতু আমাদের মধ্যে অঙ্কহীন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাই যদি বিচ্ছেদও হয় , সেটাও খুব সাময়িক বিচ্ছেদ বলেই আমি মনে করি৷ এটা চিরন্তন বিচ্ছেদ নয়৷ ’