Quantcast
Channel: Eisamay
Viewing all 222 articles
Browse latest View live

নাট্যচর্চার ইতিহাসে আসানসোলের গুরুত্ব

$
0
0

রাজেশ পাত্র
বাংলার নাট্যচর্চা বলতে শুরুতেই উঠে আসে কলকাতার নাটকের কথা৷ তার কারণ হল কলকাতায় নাটকে যেমন এক দিকে পাওয়া যায় বিশাল মঞ্চসজ্জা ও আলোক সম্পাত তেমনই অন্য দিকে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধারা ও নাট্যশৈলীর ছাপ৷ তবে সেই উপস্থাপন কি শুধু কলকাতাতেই হয় , নাকি এর বাইরেও দেখা যায় ! একটু নজর রাখলে বা পারিপার্শ্বিক অঞ্চলগুলির খোঁজখবর নিলে জানতে পারবেন কলকাতার বাইরেও এই ধরনের কাজের অস্তিত্ব আছে৷ আর এর নজির পাওয়া যায় , গোবরডাঙা , মেদিনীপুর , বোলপুর , বর্ধমান , মালদহ , শিলিগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে৷ এর ছাপ পাওয়া যায় আসানসোলেও৷

সুতরাং এই মফস্সল তকমা লাগানো শহরগুলি থেকেও উঠে আসতে পারে নতুন শৈলী , এ কথা অস্বীকার করা যায় না৷ এই তথ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য অবশ্যই উঠে আসে নাট্যব্যক্তিত্ব অজিতেশ বন্দ্যেপাধ্যায়ের নাম৷ তাঁর নাট্যভাবনার প্রসার রয়েছে সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতবর্ষে৷ আসানসোলের অন্তর্গত কুলটি স্কুল ও পরে বর্তমানের বানোয়ারিলাল ভালোটিয়া কলেজ থেকে তাঁর পড়াশোনা৷ শুধু দক্ষ অভিনেতা হিসেবেই নয় , নাট্যপরিচালনার ক্ষেত্রেও তিনি সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷ প্রতিষ্ঠা করেন ‘নান্দীকার ’ নাট্যগোষ্ঠীর৷ নাট্যভাষার সংজ্ঞা বদলেছে অনেক৷ তার বার্তা পৌঁছেছে সারা বিশ্বে৷

উদ্ভব হয়েছে কত নতুন শৈলী , রূপ বদলেছে আঙ্গিকের৷ তবে এ বার আসানসোলের নাট্যদলের হাত ধরেও নতুন শৈলী ও আঙ্গিকের প্রয়োগ উঠে আসতে দেখা যায়৷ আসানসোলের নাট্যচর্চার ইতিহাস কিন্ত্ত অনেক দিনের৷ এই ইতিহাসের পথ ধরে এগোলে আমরা দেখতে পাব এখন আসানসোলের বুকে যে দলগুলি কাজ করছে তারা হল ‘আসানসোল চর্যাপদ ’, ‘বার্ণপুর দিশারী ’, ‘আসানসোল রেপার্টারি থিয়েটার ’, ‘দোমহনি বাজার নাট্যসেনা ’, ‘কথাভাষ্য ’, ‘সতীর্থ’, ‘আসানসোল গণনাট্য ’, ‘বার্ণপুর গণনাট্য ’, ‘নান্দনিক ’, ‘আসানসোল নাট্যচর্চাকেন্দ্র ’ সহ আরও বেশ কয়েকটি দল৷

১৯১৫ সালে আসানসোলে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ’ নামে একটি বিনোদনকেন্দ্র স্থাপিত হয়৷ ১৯১৭ সালে প্রথম ‘কবি জয়দেব ’ নাটক অভিনয় করে তারা৷ পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে এর নাম বদলে ‘সুভাষ ইনস্টিটিউট ’ রাখা হয়৷ আশির দশক পর্যন্ত তাঁরা অভিনয় করেছেন ‘বিসর্জন ’, ‘শেষরক্ষা ’, ‘বিন্দুর ছেলে ’, ‘ষোড়শী ’, ‘বিল্বমঙ্গল ’, ‘হরিশচন্দ্র ’ ইত্যাদি৷ এর পরই উঠে আসে ‘হীরাপুর ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের ’-এর নাম৷ ১৯২০ সালে ‘দেবলাদেবী ’ নাটক দিয়ে শুরু হয় তাঁদের নাট্যচর্চা৷ ১৯৪৩ সালে এর নাম রাখা ‘বার্ণপুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ’ এবং ১৯৪৮ থেকে এর নাম ‘ভারতী ভবন ’৷

এর পর আসানসোলের নাট্যচর্চায় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে একের পর এক নাট্যদল , উপহার দেন প্রচুর নাটক৷ পরিকাঠামো ও উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে অনিয়মিত হয়ে ধীরে ধীরে বিলুন্তি ঘটেছে অনেক নাট্যসংস্থার৷ তবে সুদূর অতীত থেকে একই গতিতে এই ধারাকে বজায় রেখে নিয়মিত নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন এ রকম দলও রয়েছে অনেক৷ যার মধ্যে ‘আসানসোল গণনাট্য ’ চল্লিশের দশক থেকে এখনও নিয়মিত কাজ করে চলেছে৷ এদের প্রথম নাটক ‘ষড়যন্ত্র ’৷ ১৯৮৩ -তে প্রতিষ্ঠিত হয় গণনাট্যের বার্ণপুর শাখা৷ ১৯৬৩ সাল থেকে ‘দিশারী ’ প্রায় ৫৪ বছর ধরে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ‘সতীর্থ’ এখনও পর্যন্ত নিয়মিত আসানসোলের নাট্যচর্চার ধারক ও বাহক৷ ‘দিশারী ’র প্রথম নাটক ‘আজকাল ’৷

এ ছাড়াও ‘শূলের ব্যথা ’ প্রযোজনাটি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করে৷ ‘গোঁসাইপুর সরগরম ’ মঞ্চস্থ করার অনুমতি দেন গল্পকার সত্যজিত্ রায় নিজে৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় যে , তাঁরা একটি নাট্যোত্সব করে থাকেন প্রতি বছর , এখানে সারাদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয় বেশ কয়েকটি নাটক , সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন৷ এক অদ্ভুত নাট্যসমারোহের মাধ্যমে আসানসোলের নাট্যচর্চার পথকে প্রশস্ত করে চলেছেন দলের পরিচালক সমীর দত্ত , তাপস বন্দ্যেপাধ্যায় প্রমুখ৷ বর্তমানে তাঁদের নাটকগুলির মধ্যে ‘অমানবিক ’, ‘সিষ্টেম ’, ‘বাঁচান আমাদের বাঁচান ’, ‘গোলাপসুন্দরী ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য৷ এ দিকে ১৯৬৮ সালে সমবেত পরিচালনায় প্রযোজিত হয় ‘সতীর্থ’র প্রথম নাটক ‘আত্মহত্যা ’৷ এ ছাড়াও ‘লাফড়া ’, ‘গজিব কিসিম কি গাড়ি ’, ‘হনুমান চালিশা ’ প্রভৃতি পথনাটকগুলি সারা পশ্চিমবঙ্গে সাড়া ফেলেছিল৷

এই দলের বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রমাপতি চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি প্রয়াত হন৷ দলটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন আভাস ভট্টাচার্য, বাণীব্রত রাজগুরু প্রমুখ৷ এ ছাড়াও ‘বলাকা ’ নামক একটি নাট্যসংস্থা নিজেদের অস্তিত্বকে সগর্বে ঘোষণা করেছিল ১৯৭৬ সাল থেকে৷ তাদের ‘বাবাকাহিনী ’ নাটকটি সবচেয়ে সফলতম প্রযোজনা৷ তবে সাম্প্রতিককালে এই সংস্থার নাট্যচর্চা শিল্পাঞ্চলে স্তব্ধ৷ এই দলের উল্লেখযোগ্য পরিচালকেরা ছিলেন সুনীত চৌধুরী , স্বপন বিশ্বাস , বিজয় ভট্টাচার্য প্রমুখ৷ তাঁদের মধ্যে স্বপন বিশ্বাস বর্তমানে ‘আসানসোল রেপার্টরি থিয়েটার ’ নামক একটি দল পরিচালনা করেন৷ এই দলটির পরিচালক প্রবীণ হলেও অন্যান্য কলাকুশলীরা নবীন , এবং কর্মঠ৷ ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নান্দনিক ’ নামক আরও একটি নাট্যদল৷ মাঝখানের কিছুটা সময় এই দলের গতি কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে , কিন্ত্ত বর্তমানে অন্যান্য দলগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই দলটিও কিছুটা সক্রিয় হয়ে উঠেছে৷ ‘ঠিকানা ’, ‘তুষাগ্নি ’, রামরাজ্য ইত্যাদি এই গোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য নাটক৷ তবে এই শহরের সবচেয়ে নবীনতম দলটি হল ‘আসানসোল চর্যাপদ ’৷

পরিচালক ও অন্যান্য কলাকুশলী থেকে শুরু করে প্রত্যেকেই নবীন৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ওরে আমার নবীন , ওরে আমার কাঁচা / আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা ’ এরই যেন প্রতিফলন ঘটেছে এই শিল্পাঞ্চলে৷ আসানসোলের নাট্যমুখী মানুষজনদের সাথে কথা বলে জানতে পারা যায় যে , বেশ কয়েক বছর আগেও নাকি আসানসোলের নাট্যচর্চা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল৷ তবে সম্প্রতি ‘আসানসোল চর্যাপদ ’, ‘আসানসোল রেপার্টরি থিয়েটার ’ প্রভৃতি নাট্যদলগুলির হাত ধরে আবার নতুন ভঙ্গিমায় নাটকের স্বাদ পেয়েছে শহরবাসী৷ ঠিক যেমন বর্তমানে ‘আসানসোল চর্যাপদ ’-এর নাটক ‘লজ্জা ’ সারা পশ্চিমবঙ্গে ও রাজ্যের বাইরে সাড়া ফেলেছে , এ ছাড়া তাদের ‘এমনও হয় ’ ও ‘অন্যরকম ’ নাটক দু’টিও সম্পূর্ণ নবধারায় নির্মিত দু’টি নাটক৷ এখানে দেখা যায় একেবারে নতুন আঙ্গিক , নতুন শৈলী৷ এই বিষয়ে অবশ্যই উঠে আসে নৃত্যের গবেষিকা সায়ন্তী চট্টোপাধ্যায়ের নাম৷ এ ভাবেও নাটককে ভাবা যায় !

যেখানে কোনও নিপাত গল্প নেই , কোনও অভিজ্ঞ অভিনেতা নেই , রয়েছে কিছু সুন্দর কম্পোজিশন , আলোর অসাধারণ প্রক্ষেপণ , বেশ কিছু অভাবনীয় সত্য ও অসীম সাহস৷ রয়েছে অভি চক্রবর্তীর নাটক ও পরিচালনায় ‘বিষছায়া ’, সুপ্রিয় কাঞ্জিলালের নাটক ও রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘ঘোড়ার ডিম ’, রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তীর নাটক পরিচালনায় ‘সাঁঝ সকালের মা ’ ও ‘দেবতার গ্রাস ’-এর মতো নাটকও , যা একটি আবৃত্ত নাটক৷ দলের পরিচালক রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী শুধুমাত্র থিয়েটারকে ভালোবেসেই এটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন৷ প্রবীণ পরিচালক ও শহরবাসীর কাছে প্রচুর ভালোবাসা ও এগিয়ে চলার সাহস পেয়েছেন তিনি৷

অন্য দিকে ‘আসানসোল রেপার্টরি থিয়েটার ’-এর নবনাটক ‘তামাশামঙ্গল ’ পরিচালক স্বপন বিশ্বাসের সান্নিধ্যে একটি অন্যধারার রূপ পেয়েছে৷ তাদের অন্যান্য নাটকগুলি হল ‘হ্যালো মম ’, ‘সীতা ’, ‘একলব্য ’, ‘জোড়াপল্টন ’, ‘রথের রশি ’ প্রভৃতি৷ তা ছাড়া ‘কথাভাষ্যে ’র পরিচালক তাপস দত্তের নির্দেশনায় সুন্দর রূপ পায় ‘পুনর্বহাল ’, ‘আত্মপক্ষ ’, ‘দহনকাল ’-এর মতো নাটক৷ ২০০৬ সালে প্রথম ‘অজ্ঞাতবাস ’ নাটকের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এই দলের পথ চলা৷ আসানসোলের মূল শহর থেকে একটু দূরে দোমহনিতে ‘দোমহনি বাজার নাট্যসেনা ’ নামক একটি নাট্যসংস্থার নাটক ‘মহাভারতের যুদ্ধ’ সারা পশ্চিমবঙ্গ দাপিয়ে অভিনয় করে চলেছে৷ নাটকটি পরিচালনা করেন গৌতম ভট্টাচার্য৷ এ ছাড়াও এই সংস্থার অন্যান্য নাটকগুলি হল ‘তবুও শপথ ’, ‘দাঁড়াও সম্মুখে ’ প্রভৃতি৷ এই নাটকগুলি পরিচালনা করেন প্রদীপকুমার সাধু৷

মূলত এই শিল্পাঞ্চলের বুকে যেমন পুরোনো দলগুলি রয়েছে তেমনই প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্বরা নাটকে অভিনয় করেন৷ তেমনই ‘আসানসোল নাট্যচর্চা’র মতো নতুন দলও রয়েছে৷ এখনও দলটি অনুমোদিত হয়নি তবুও অক্লান্ত ভাবে আসানসোলের নাট্যসংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷ তবে অগ্রজদের কাছে তাদের শেখা বাকি অনেক৷ তাদের অগ্রসরে র পথে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ‘আসানসোল চর্যাপদ ’-সহ অন্যান্য নাট্যদলগুলি , ঠিক যেমন তাদের এগিয়ে আসতে সাহায্য করেছিলেন প্রবীণেরা৷ মুকাভিনয়ের এর একটি বড় চর্চাকেন্দ্রও রয়েছে শহরে , যার নাম ‘অমিয় মেমোরিয়াল ক্রিয়েটিভ আর্টস ’৷ এর স্রষ্টা কল্পতরু গুহ রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন৷

বিভিন্ন দলগুলি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি বছরে নাট্যমেলার আয়োজন করে থাকে , যেখানে অংশ নেয় আসানসোল ও তার বাইরের বিভিন্ন নাট্যদল৷ বলাবাহুল্য এখানেই উঠে আসে বেশ কিছু সমস্যার কথা৷ কলকাতার দলগুলির নাটকের জন্য যে পরিমাণ দর্শক পেক্ষাগৃহে আসেন তার অর্ধেক দর্শকও কিন্ত্ত স্থানীয় দলের নাটক দেখতে আসেন না৷ এই প্রসঙ্গে দর্শকের মানসিক প্রবৃত্তির কথাও যেমন উঠে আসে তেমনই উঠে আসে অর্থনৈতিক দিকটির কথাও৷ আসানসোলের দলগুলি এখনও পর্যন্ত সেই ভাবে সরকারি সাহায্য পান না , তাই তাদের ব্যক্তিগত লগ্নিতেই সাধ্য মতো এগিয়ে যেতে হয়৷ কলকাতার নাটক বেশি ভালো আর মফস্সলের নাটক কম ভালো এই মনোভাবের পক্ষপাতী হলে প্রথমেই বুঝতে হবে আপনি এখনও পূর্ণমনস্ক হয়ে উঠতে পারেননি৷ এখানেও সৃষ্টি হয় লজ্জার মতো নতুন শৈলীর নাটক৷ ডকুমেন্টারি নাটক এর আগে পশ্চিমবঙ্গের নাট্য ইতিহাসে খুব বেশি দেখা যায়নি৷ বিশ ও ত্রিশের দশকে এই ধরনের নাট্যরীতির উদ্ভব হয় যাকে বলা হত ‘থিয়েটার অফ ফ্যাক্ট ’৷ বিশ্বভারতী বিশবিদ্যালয়ে থিয়েটার বিষয়ে স্নাতকস্তরে এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিনয় বিষয়ে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণির প্রথম হওয়া বর্তমানের নাট্যগবেষক , ‘আসানসোল চর্যাপদ ’ দলের পরিচালক রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী এই ধরনের থিয়েটারকে বিশেষ ভাবে মঞ্চস্থ করেন৷ বছরে একটি নাট্য পত্রিকাও প্রকাশ করেন তিনি , তাঁর এই প্রয়াসকে অত্যন্ত সাধুবাদ জানাই৷ তার দলে বাঁকুড়া , ঝাড়খণ্ড , বর্ধমানের বেশ কিছু নাট্যকর্মী নিয়মিত থেকে নাট্যাভ্যাস করেন , এবং তার ব্যয়ভার বহন করেন পরিচালক নিজে৷ তাঁর মতে , ‘আসানসোলে পূর্ণ সময়ের থিয়েটারকর্মীর অভাব রয়েছে , থিয়েটারকে সক্রিয় ভাবে মননে জায়গা দিতে হবে৷ এটি একটি বিশ্বশিল্প , তাই নাটককে মনোগ্রাহী করে নিয়মিত দর্শক তৈরি করার দায়টাও নাট্যকর্মীদেরই৷ সত্ ভাবে থিয়েটার করলে এখানেও রুটিরুজির জায়গা আছে৷ ’নাটক ও নৃত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আলোকসম্পাত৷ সায়ন্তী চট্টোপাধ্যায়ের ‘ট্রিবিট টু’, ‘তবু মনে রেখো ’ ইত্যাদি নাট্য ও নৃত্যের মিশ্রশিল্পে এর প্রয়োগ দেখা যায়৷ আসানসোলের নাট্যজগতে সেই অতীত থেকে জড়িয়ে রয়েছে , আলোকশিল্পী বাবলু ভট্টাচার্যের নাম৷ এই মানুষটি দীর্ঘদিন আলোকসম্পাদনা ও প্রক্ষেপণের মাধ্যমে দেখেছেন এই শহরের থিয়েটারের একাল -সেকাল৷ এ ছাড়াও বর্তমানে বিবর্তনের থিয়েটারকে আলোকিত করে চলেছেন সন্ত্ত ভট্টাচার্য, নির্মল ভট্টাচার্যের মতো আলোকশিল্পীরা৷

বর্তমান থিয়েটারের উন্নতি সম্ভব নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই৷ মফস্সলের নাটকও সমাদৃত হচ্ছে কলকাতাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্নপ্রান্তে৷ এই শিল্পের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের শহরবাসীর৷ আমাদের উচিত্ উপযুক্ত প্রবে শমূল্য দিয়ে নাটক দেখার সু-অভ্যাস গড়ে তোলার৷ সেই সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে৷ উপযুক্ত পেক্ষাগৃহ বা মঞ্চের যথেষ্ট অভাব রয়েছে এখানে৷ উন্নত যোগাযোগের মধ্যে ‘রবীন্দ্রভবন ’ প্রেক্ষাগৃহটি এক দিকে যেমন ব্যয়বহুল তেমনই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্সবের সমারোহ এখানে ঘটে থাকায় এটি সহজলভ্যও নয়৷ এ ছাড়া রয়েছে ‘ভারতীভবন ’, তবে এই প্রেক্ষাগৃহটি যোগাযোগের দিক দিয়ে সামান্য বিচ্ছিন্ন৷ ‘সম্প্রীতি ’ নামক প্রেক্ষাগৃহটি এখনও পরিকাঠামোগত ভাবে উন্নত নয়৷ প্রয়োজন আরও প্রেক্ষাগৃহ , প্রচুর মঞ্চ ও মুক্তমঞ্চের৷ বর্তমানে ‘আসানসোল চর্যাপদ ’, ‘আসানসোল রেপার্টরি থিয়েটার , ‘দিশারী ’, প্রভৃতি নাট্যদলগুলির কিছু নিয়মিত দর্শক তৈরি হয়েছে৷ এ বিষয়ে বলে রাখি শুধুমাত্র এই দলগুলির নাটক দেখলেই নাট্যচর্চার প্রয়াস সফল হবে না , বাকি দলগুলির নাটকও দেখা উচিত্ তবেই বাড়বে নতুন শৈলী , বাড়বে চেতনা , বাড়বে উত্সাহ৷ চলুন আর এক -পা এগিয়ে যায় আমরা , কয়েক -পা এগিয়ে দিই এই শহরের নাট্যচর্চাকে৷


'ইনভিটেশন' নয়, এবার 'সিলেকশন'

$
0
0

দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-র পথেই হাঁটছে কলকাতার মিনার্ভা৷ ২০১৭ জাতীয় নাট্যোত্সবের বাছাই পর্বে এসেছে আমূল পরিবর্তন৷ খোঁজ নিয়ে লিখছেন ইন্দ্রনীল শুক্লা

মিনার্ভা নাট্যচর্চা কেন্দ্রের জাতীয় নাট্য উত্সব এ বার তৃতীয় বছরে পড়ল৷ গত দুই বছরে মিনার্ভার উত্সবে বেশ কিছু গ্ল্যামারাস অভিনেতার নাটক দেখতে পাওয়া গিয়েছে৷ মিনার্ভা হলের পাশাপাশি রবীন্দ্র সদনে আয়োজিত উত্সবে দেখা গিয়েছে অনুপম খের, নাসিরুদ্দিন শাহ, শরমন যোশি, সৌরভ শুক্লা-দের নাটক৷ মানে নাটক থেকে তাঁরা উঠে এসেছেন ঠিকই, কিন্ত্ত ফিল্মের কারণে তাঁদের সারা দেশ চেনে৷ এ বছর অবশ্য সেটি হচ্ছে না৷ আমন্ত্রণ করে আনা হচ্ছে না কোনও নাট্যদলকে৷ উত্সবে সেসব নাটকই অভিনীত হবে, যে সব নাটককে বাছাই করে নেওয়া হবে৷ অর্থাত্ এ বার আর 'বাই ইনভিটেশন' নয়, নাটক নেওয়া হচ্ছে 'বাই সিলেকশন'৷ বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশের নানা নাট্যদলকে উত্সবে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে৷ ডেডলাইন ছিল ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত৷ এ ছাড়াও রেপার্টরির নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে, অন্য রাজ্যের পরিচিত ও বড় নাট্যদলের মাধ্যমে বিভিন্ন দলকে অ্যাপ্লাই করতে উত্সাহিত করা হয়েছে৷ শ'খানেক অ্যাপ্লিকেশন ইতিমধ্যেই বাছা হয়েছে৷ তা থেকে চড়ান্ত করা হবে ২০-২২ টি নাটককে৷ মিনার্ভা ও রবীন্দ্র সদন মিলিয়ে উত্সব হবে ১১ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত৷ প্রয়োজনে মিনার্ভায় উত্সবের শো কয়েক দিন বাড়ানোও হতে পারে৷ আর সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে ৬ থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত৷

এই নতুন পন্থায় উত্সবকে সাজাতে উদ্যোগী হয়েছে মিনার্ভা নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নতুন পরিচালন কমিটি৷ যার চেয়ারপার্সন অর্পিতা ঘোষ৷ অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন সঞ্চয়ন ঘোষ, সুদর্শন চক্রবর্তী, অনীশ ঘোষ, সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, আশিস দাস, আশিস চট্টোপাধ্যায়, সত্য ভাদুড়ি প্রমুখ৷ মিনার্ভা কর্তৃপক্ষের দাবি এ ভাবে 'বাই অ্যাপ্লিকেশন'-এর মাধ্যমে বাছাই-উত্তর উত্সব একমাত্র ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা ছাড়া দেশের আর কোথাও হয় না৷

রাজ্য তথা দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনলাইনে কিংবা ডিভিডি-র মাধ্যমে যে সব অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছে তার থেকে সেরাগুলিকে বাছার জন্য একটি পৃথক স্ক্যানিং কমিটি গড়া হয়েছে৷ এ কমিটিতে রয়েছেন বিভাস চক্রবর্তী, অরুণ মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, অশোক মুখোপাধ্যায়, ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়, ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, অবন্তী চক্রবর্তী প্রমুখ৷ অবশ্যই চড়ান্ত বাছাই পর্যায়ে নাট্যচর্চাকেন্দ্রের পরিচালন কমিটিও অংশগ্রহণ করবে৷

কেন এই পরিবর্তন? অর্পিতা ঘোষ বলেন, 'প্রথম দু বছরে উত্সবকে জনপ্রিয় করার জন্য স্টারের প্রয়োজন ছিল৷ নাসিরুদ্দিন শাহ, অনুপম খের-এর মতো অভিনেতারা অবশ্যই খুব ভাল অভিনেতা এবং তাঁরা স্টেজ থেকেই উঠে এসেছেন, কিন্ত্ত তাঁদের তো সকলে ফিল্মের জন্যই বেশি করে চেনেন৷ এ বার থেকে আমরা চাইছি মানুষ নাটকের উত্সবে যেন বেশি করে নাটকের স্টারদের খুঁজে নিতে পারেন৷' রয়েছে আরও কিছু কারণও৷ অর্পিতা ব্যাখ্যা করে বললেন, 'নাসিরুদ্দিন-অনুপম খের-এর মতো নামী অভিনেতাদের গ্রুপকে ভাল পরিমাণ টাকা অ্যাডভান্স করতে হয়৷ তাতে অনেক সময়ই অসুবিধা হয়েছে৷ তাছাড়া এনএসডি-র অনেক বেশি টাকা৷ ওঁরা অনেক কিছু অ্যাফোর্ড করতে পারে৷ মিনার্ভাকে একটা নির্দিষ্ট বাজেটে চলতে হয়৷ তার মধ্যেই সেরা উত্সবের চেষ্টা করা হচ্ছে৷ একই টাকায় বেশি পরিমাণ ভাল নাটক উত্সবে আনতে পারাটাও তো ভাল ব্যাপার৷' অন্য প্রদেশের নামী দলগুলো কি তবে আর মিনার্ভার উত্সবে দেখা যাবে না? অর্পিতা বলেন, 'এই বছরে কোনও নামী দলকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না৷ সামনের বছর থেকে হয়তো একটা বা দু'টো অন্য প্রদেশের নামী থিয়েটারের দলকে আলাদা করে আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে৷ দেখা যাক৷'

এনএসডি সাধারণত ফোক, ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং এ রকম কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে৷ মিনার্ভা উত্সবে নাটক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনও বিষয়কে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কী? অর্পিতা বলছেন, 'না আলাদা করে কোনও ক্যাটেগরিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না৷ বিচারকরা সার্বিকভাবে দেখে বেছে নেবেন৷' নাটক বাছাইয়ের পন্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিলেকশন কমিটির সদস্যা অবন্তী চক্রবর্তী বলেন, 'যে কোনও নাটকই হোক না কেন, সেটা লার্জার প্ল্যাটফর্মে মঞ্চস্থ হওয়ার পক্ষে কতখানি যোগ্য সেটাই দেখা হচ্ছে৷ ফোক থেকে শুরু করে অল্টারনেটিভ ফর্মের কোনও নাটকও হতে পারে, তাতে কোনও বাধা নেই, কিন্ত্ত মানগতভাবে যেন জাতীয় নাট্যোত্সবের পক্ষে মানানসই হয়৷' রাজ্যের বেশ কিছু দল তো বটেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা নাটকগুলিও সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে৷ তালিকায় আছে কাশ্মীর থেকে শুরু করে অসম, মণিপুর, গুজরাত,কেরল, তামিলনাড়ু-র নাটক!

box item

অর্পিতা ঘোষ: মিনার্ভাকে একটা নির্দিষ্ট বাজেটে চলতে হয়৷ তার মধ্যেই সেরা উত্সবের চেষ্টা করা হচ্ছে৷ একই টাকায় বেশি পরিমাণ ভাল নাটক উত্সবে আনতে পারাটাও তো ভাল ব্যাপার৷

অবন্তী চক্রবর্তী: ফোক থেকে শুরু করে অল্টারনেটিভ ফর্মের কোনও নাটকও হতে পারে, তাতে কোনও বাধা নেই, কিন্ত্ত মানগতভাবে যেন জাতীয় নাট্যোত্সবের পক্ষে মানানসই হয়৷


নাটকের প্রবাসী ভাষা

$
0
0

প্রবাসী বাঙালিদের নাটক৷ এটা বাংলা নাট্যমেলার নতুন একটা ট্রেন্ড৷ খোঁজ নিলেন ইন্দ্রনীল শুক্লা

নান্দীকার, ব্রাত্যজন তো বটেই, অন্য কয়েকটি দলের নাট্যোত্সবেও এতদিন অন্য রাজ্যের অথবা অন্য দেশের, অন্য ভাষার নাটকের দেখা মিলতো৷ তারই সঙ্গে এখন একটা নতুন ট্রেন্ড চোখে পড়ছে৷ উত্সবে যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে প্রবাসী বাঙালিদের নাট্যদলগুলিকে৷ তাঁরা আমন্ত্রিত৷ ভাষাটা বাংলা, মানুষগুলোও প্রায় সকলে জন্মসূত্রে বাংলার, কিন্ত্ত কর্মসূত্রে থাকেন বিদেশে৷ এমনই দু'টি দল হল থিয়েট্রিক্স এবং ইসিটিএ (ইথনোমিডিয়া সেন্টার ফর থিয়েটার আর্টস)৷ দুটি দলই আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের৷ প্রথম দলটি ওয়াশিংটনের৷ আর পরেরটি নিউ জার্সির৷ দিব্যেন্দু পালের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় এসেছে থিয়েট্রিক্সের 'বাড়িটা তুই আছিস কেমন?'৷ আর পিনাকী দত্তের পরিচালনায়, সুদীন্ত ভৌমিকের রচনায় এসেছে ইকটা-র 'কোল্ড ফিউশন'৷

'বাড়িটা' নাটকটি সরাসরি প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গেই যুক্ত৷ এ নাটকে এক বৃদ্ধ ওয়াশিংটনে গিয়ে তার মেয়ের চমত্কার বাংলো বাড়িতে থাকে৷ সাউথ ইন্ডিয়ান জামাই ছেলেটিও ভালো৷ কিন্ত্ত নানা সুখের মধ্যে থেকেও শান্তি খুঁজে পান না বৃদ্ধ৷ বিদেশে বসেও তাঁর মন কাঁদতে থাকে কলকাতার চেনা গলি, চায়ের দোকানের আড্ডা, রিক্সা-ট্রামের শব্দ, ফেরিওয়ালার হাঁক ইত্যাদির জন্য৷ বিদেশে অচেনা পরিবেশে নিজেকে কেমন করে মানিয়ে নেবেন তিনি? আদৌ কি মানিয়ে নেওয়া সম্ভব? সে প্রশ্নই উঠে এসেছে নাটকে৷ কলকাতায় ইতিমধ্যেই এ নাটক অভিনীত হয়েছে নান্দীকার উত্সবে৷ শো হয়েছে উত্তরপাড়া সমতট উত্সবে এবং প্রাচ্য-র আমন্ত্রণেও৷

অন্যদিকে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে বাংলার এক প্রত্যন্ত এলাকার কলেজে চলে আসা এক অধ্যাপকের কাহিনি রয়েছে 'কোল্ড ফিউশন' নাটকে৷ তবে সে নাটকের প্লট এক পুরনো বিজ্ঞান-বিতর্ককেও উস্কে দিয়েছে৷ পনস আর ফ্রিসম্যান দুই বিজ্ঞানী আশির দশকের গোড়ায় জলের পাত্রে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন তাপমাত্রা বাড়ছে৷ তাঁরা মত দেন, আশ্চর্যজনকভাবে দুটো প্রোটন কণা পাশাপাশি এসে জুড়ে যাওয়ার কারণেই অতিরিক্ত তাপ তৈরি হচ্ছে৷ এত সহজে পরমাণু শক্তি তৈরি হওয়া সম্ভব! এই গবেষণা তখনকার মতো অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বানচাল করেন৷ তবু পরেও এর গবেষণা চালাতে থাকেন অনেকে৷ চেষ্টা হয় ভারতেও৷ তেমনই এক কাল্পনিক কাহিনি নিয়ে তৈরি নাটকের প্লট৷ প্রোটনের সঙ্গে প্রোটনের মিলে যাওয়ার বিষয়টিকে নাটকে সমকামীতার সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে৷ এ নাটক অভিনীত হয়েছে উত্তরপাড়া সমতট উত্সব, গঙ্গা-যমুনা উত্সব, কৃষ্ণনগরের পরম্পরা উত্সবে৷

'কোল্ড ফিউশন'-এ চ্যানেলের অ্যাঙ্কারের চরিত্রে রয়েছেন ঋতুপর্ণা দাশ, যিনি নিজেও একসময় সত্যিই চ্যানেলে সাংবাদিকতা করেছেন৷ রয়েছেন পারমিতা চক্রবর্তী, কঞ্জস চক্রবর্তী, সৌমেন্দু ভট্টাচার্য প্রমুখ৷ 'বাড়িটা'-র জন্য পরমা সান্যাল, অরবিন্দ ঘোষ, মিতা পাল প্রমুখরা এসেছেন৷ এ ভাবে বিদেশ থেকে এসে বাংলা নাটক করা কঠিন ব্যাপার৷ কারণ, সকলেই তো সেদেশে চাকরি-বাকরি করেন৷ 'বাড়িটা'-র পরিচালক দিব্যেন্দু পাল জানালেন, 'আমরা সকলেই তো বছরে একবার করে দেশে আসি৷ নাটকটা করার জন্য সকলেই সময়টা এমনভাবে সাজিয়েছি যেন বাড়িও যাওয়া যায় আবার সেই মাস দেড়েক সময়টা কাজে লাগিয়ে নাটকও করা যায়৷' প্রায় একই সুর 'কোল্ড ফিউশন'-এর পরিচালক পিনাকী দত্ত-র গলায়ও৷ বলছেন, 'আমাদের দলের সকলের সঙ্গে আলোচনা করেই এই সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে৷ বাড়ি যাওয়াও হবে, আবার নাটকও করা যাবে৷' 'কোল্ড ফিউশন'-এর নাট্যকার সুদীন্ত ভৌমিক বলছেন, 'আমার মতো এমন কয়েকজনও আছেন যাঁদের এখন আসার কথা ছিল না৷ কিন্ত্ত নাটক করব বলেই একসঙ্গে চলে এলাম৷'

কিন্ত্ত লোকজন এলেই তো হয় না৷ একটা নাটকের জন্য তো সেট, আলোর প্রয়োজন৷ সেটা কেমন করে সামলানো গেল? সুদীন্তবাবুরা জানাচ্ছেন, কলকাতার সায়ক এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে৷ তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে নান্দীকার-এর সঙ্গেরও৷ নান্দীকারের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে সহযোগিতার কথা জানালেন দিব্যেন্দুবাবুও৷ তাঁরা বিদেশ থেকে স্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে কনসেপ্ট জানিয়েছিলেন৷ সেইমতো এখানে সেট-আলোর কর্মীরা কাজ করে দিয়েছেন৷ আর এখানকার নাটক? পিনাকী-ঋতুপর্ণারা দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের 'সওদাগরের নৌকো' দেখেছেন৷ দিব্যেন্দুবাবুরা দেখেছেন ব্রাত্য বসুর 'অদ্য শেষ রজনী'৷


ভয়ের উত্সে নাটকীয় আঘাত

$
0
0

ব্লগার খুন৷ শ্রীজাত-র কবিতা৷ সেই ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’তে সুর দিলেন শ্রীকান্ত৷ পাঠে ব্রততী৷ দেবেশের পরিচালনা৷ খোঁজ নিলেন ইন্দ্রনীল শুক্লা

প্রতিবেশী রাষ্ট্রে একটা খুন! আর তার প্রেক্ষিতে হঠাত্ করেই কিছু পংক্তি লিখে ফেলেছিলেন শ্রীজাত৷ পোস্ট করে দিয়েছিলেন ফেসবুকে৷ কী সেই ঘটনা? একটু পিছিয়ে যেতে হবে৷ ২০১৫ সাল৷ তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি৷ স্থান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের বইমেলা প্রাঙ্গণ৷ সময় রাত আটটা৷ বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন সস্ত্রীক অভিজিত্ রায়৷ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্লগ লেখেন তিনি৷ বার বার প্রাণনাশের হুমকির পরেও ধর্মান্ধতাকে তুলোধোনা করতে পিছপা হন না৷ কিছু বোঝার আগেই কয়েকজন ঘিরে ফেললেন অভিজিত্ আর তাঁর স্ত্রীকে৷ অভিজিত্কে কোপানো হল চপার দিয়ে৷ দেহ ফালাফালা হল৷ রক্তে নদী৷ তিনি মারা গেলেন ঘটনাস্থলেই৷ মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তাঁর স্ত্রীকে৷ কিন্ত্ত শুধু অভিজিত্ই নন৷ ক্রমে আহমেদ রাজীব হায়দার, সুননুর রহমান, শফিউল ইসলাম, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, নরেন্দ্র দাভেলকর, গোবিন্দ পানসারে, প্রফেসর কুলবর্গি... তালিকাটা ক্রমেই বাড়তে থাকল৷ আর শ্রীজাত-র কবিতার সংখ্যাও বেড়ে যেতে লাগল৷ শেষে গত বইমেলার গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’৷ ৫২টি কবিতা৷ আর এই কাব্যগ্রন্থকেই এবার মঞ্চ উপস্থাপনায় নিয়ে আসতে চলেছে বেলঘড়িয়া শঙ্খমালা৷

দলের কর্ণধার সুমন্ত্র সেনগুপ্ত’র থেকে জানা গেল প্রযোজনায় ব্যবহূত হচ্ছে ৩২টি কবিতা৷ বাচিক শিল্প, থিয়েটার ও সঙ্গীতের সমন্বয়ে এক নিরীক্ষা৷ গত ২৫ বছর ধরেই বাচিক শিল্পে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছে শঙ্খমালা৷ এটিও তেমনই এক প্রয়াস৷ সমগ্র প্রোডাকশনটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়৷ পাঠে সুমন্ত্র ছাড়াও অংশ নেবেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীজাত ও দলের শিল্পীরা৷ সংগীত সামলেছেন শ্রীকান্ত আচার্য৷

শ্রীজাত বলছেন, ‘একই লোকের লেখা, একই বিষয়ের উপর এতগুলো কবিতা কেমন লাগবে তা নিয়ে প্রথমে চিন্তায় ছিলাম৷ কিন্ত্ত দেবেশদা এমনভাবে কবিতাগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে মঞ্চরূপ দিয়েছেন যে খুব অন্য রকম লাগছে৷ তাছাড়া আমিও নিছক পাঠ করছি না৷ আংশিকভাবে অভিনয়ও করতে হচ্ছে৷ তাই নতুনত্ব রয়েছে৷’

গোটা দশেক কবিতা পাঠ করছেন ব্রততী৷ কিন্ত্ত আংশিক অভিনয় করতে হচ্ছে তাঁকেও৷ এ রকম ডিজাইনের প্ল্যানটা সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় দেবেশ বলছেন, ‘সন্ত্রাসের বাতাবরণ এবং তার মধ্যে নীরব হয়ে থাকার ভয়াবহতাটা তুলে ধরতে চেয়েছি৷ ভয়ানক কিছু ঘটতে দেখেও প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে থাকা মারাত্মক ব্যাপার৷ অথচ সেটাই ঘটছে বাস্তবে৷ এই সব কিছু মিলিয়েই সার্বিক ছবি আঁকা হচ্ছে মঞ্চে৷’

শ্রীকান্ত আচার্য জানাচ্ছেন, এই প্রোডাকশনের তিনি সঙ্গীত পরিচালক এ রকম বললে ঠিক বোঝানো যাবে না৷ ব্যাখ্যা করে বলছেন, ‘বলা ভালো আমি আবহ তৈরি করেছি৷ চালচিত্র তৈরি করেছি৷ কবিতাগুলোর উপস্থাপনকে কমপ্লিমেন্ট করতে পারে এমন গান বাছা হয়েছে৷ কবীরের ভজন, লালনের গান, বব ডিলানের ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’-এমন অনেক কিছুই থাকছে৷ ন্যাচরাল সাউন্ডও ব্যবহার করা হচ্ছে৷’

উপস্থাপনায় যে নতুনত্ব রাখা হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে দেবেশ বলছেন, ‘কবিতা নিয়ে কাজ করার প্রবণতা আমার অনেকদিনই ছিল৷ বিবেকান্দকে নিয়ে ওঁদের দলের জন্য ‘বীরেশ্বর’-এর কাজ করি৷ শ্রীজাত-র কবিতা নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব যখন সুমন্ত্র দিল, উত্সাহিত বোধ করলাম৷ মনে হল কবিতাগুলোর জন্য মঞ্চে আলাদা আলাদা রকমের ভিস্যুয়াল তৈরি করা যাক৷ শ্রীজাত, ব্রততী যাঁরা কবিতা নিয়মিত পড়েন কিন্ত্ত অভিনয় করতে হয় না, তাঁদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছি কবিতাগুলোরই প্রয়োজনীয় মুহূর্ত গড়ার তাগিদে৷’

শব্দে, গানে, আলোয়, অভিব্যক্তিতে কবিতার মুহূর্ত কেমন তৈরি হল তা দেখতে অপেক্ষা সামান্যই৷ ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ মঞ্চস্থ হবে আগামী ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায়, কলামন্দিরে৷

সিপিএম-সিপিএম প্রেম

$
0
0

সাক্ষী যখন মঞ্চ ! সৌরভ পালোধী আর তূর্ণা দাস৷ লিখছেন ভাস্বতী ঘোষ

হাতে সময় দিন তিরিশ৷ তারপরই প্রেমের উত্সবে গা ভাসাবে এ শহর৷ তাই এই মরশুমে শহরে ঘটে যাওয়া জমজমাট প্রেমের কাহিনির খোঁজে বেরিয়েছিলাম৷ প্রথমেই চোখ আটকাল মঞ্চে ! এ প্রেমে যে নাটকীয়তা থাকবে , সে কি আর বলে দিতে হবে ? প্রেমিকের নাম সৌরভ পালোধী৷ আর তাঁর প্রেমিকাটির নাম তূর্ণা দাস বলেই , অনেক পুরুষের হূদয়ে হালকা ধাক্কা ! নাটকের মঞ্চে তূর্ণা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ৷ অনেকদিন ধরেই অবশ্য চুটিয়ে মন দেওয়া -নেওয়ার পালা চালিয়েছেন দু’জনে৷ আর এবার বিয়ের পিঁড়িতে৷

সৌরভ এমনিতে টালিগঞ্জের পরিচিত মুখ৷ তবে তূর্ণা দাস -এর ফ্যানফলোয়িং কি একটু বেশি ? সৌরভ নিজেই তো স্বীকার করে নিচ্ছেন সে কথা৷ অনর্গল বলতে লাগলেন , ‘দিনটা মনে আছে৷ ২০১৪ -র ১০ মে৷ অ্যাকাডেমিতে আমার নাটক চলছিল৷ তূর্ণা দেখতে এসেছিল৷ আমি কিন্ত্ত তার বহু আগে থেকেই নাটকের মঞ্চের তূর্ণা দাসের ফ্যান৷ ওর সঙ্গে যে জায়গায় আলোচনা জমল , সেটা পলিটিক্যাল নাটক নিয়ে৷ পলিটিক্যাল নাটক শহরে কম হয় , তা নিয়ে তূর্ণার একটা ক্ষোভ ছিল৷ সেই জায়গায় আমি পয়েন্ট স্কোর করলাম ‘বুদ্ধিজীবী ’ বানিয়ে৷ আমাদের প্রেমটা সিপিএম -সিপিএম প্রেম৷ তূর্ণা আমায় জিজ্ঞেস করেছিল , ‘তুমি কি নকশাল ’? উত্তরে আমি বলি , ‘আমি তো চিরকালই এসএফআই ’৷ এরপর থেকে বন্ধুত্ব গাঢ় হল৷ আমার ‘ইচ্ছেমতো ’ দলে তূর্ণা বড় ভূমিকা পালন করতে শুরু করল৷ ’ এমনিতে তূর্ণা সৌরভের চেয়ে সাড়ে তিন বছরের বড়৷ তূর্ণা-ও হেসে বলছেন , ‘আসলে আমাদের মধ্যে ঝগড়াটাই বেশি হয়৷ মানে আমরা মারপিট -ও করি আরকী ! কারণ আমরা ভয়ঙ্কর ভালো বন্ধু৷ সৌরভ আসলে গৌতম হালদারের অন্ধ ভক্ত৷ আমি যখন ‘আরব্য রজনী ’ নাটক করছি , ও তখন গৌতম হালদারকে দেখতে রোজ আসত৷ আর যতবার আসত , ততবার মঞ্চেআমায় দেখত৷ ’এই নাটকের মঞ্চের প্রেমের তীব্রতা এতটাই , যে সৌরভ আর তূর্ণা সাতপাকে বাঁধা পড়ছেন এই শীতেই৷ কিন্ত্ত প্রেম হলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তো নয় ! বরং বিয়ে সামালাতে হিমশিম হওয়ার আশঙ্কা৷ তা হলে ? সৌরভ বলছেন , ‘এখন যে যার নিজের বাড়ি যাই৷ বিয়ের পর একবাড়িতে ফিরব৷ এর বাইরে আর তো কিছু আলাদা নেই ! এখন আমরা যেভাবে আছি , সেরকমভাবেই থাকব৷ আসলে আমাদের অধিকাংশ সময় নাটকের দল ‘ইচ্ছেমতো ’ নিয়েই কাটে৷ আমাদের বিয়ের পিছনেও দলের সদস্যদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে৷ অনেকে জিজ্ঞেস করছেন হানিমুনে আমরা দু’ জন কোথায় যাব৷ এখন তাঁদের এটাই বোঝাতে হবে , যে আমরা দু’ জন মিলে কোথাও যাব না৷ দলের সব সদস্যরা মিলেই যাব!’

এই প্রেম হল কী খেয়ে ? সৌরভ হেসে বলছেন , ‘চাইনিজ রেস্তোরাঁয় গিয়ে যে দু’ জনে মিলে খাইনি তা নয়৷ আবার যদি এরকম হয় যে , ফুচকা খেয়েই প্রেম করতে হবে , তা হলে আর এ প্রেম হত না ! বরং এই প্রেমে বেশি খাওয়া হয়েছে রুটি আর আলুরদম৷ রিহার্সালের সময়৷ ’ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করেন না এই প্রেমিক -প্রেমিকা৷ তাই এই শীতে কলমের সইয়ে তাঁরা একে -অন্যের হবেন , ইচ্ছে সেরকমই৷ আর তারপর বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে জমিয়ে খাওয়া -দাওয়া তো আছেই ! তারিখ জানুয়ারি ২২৷ তবে টিকিট কেটে সেই শো আপনি দেখতে চাইলেও , দেখতে পাবেন না৷ এদিন সৌরভ আর তূর্ণা মঞ্চে আসবেন , একে -অন্যের জন্য !

এই ‘মুক্তধারা’ ভাঙবে শহুরে বাঁধ?

$
0
0

রবি ঠাকুরের ‘মুক্তধারা’৷ অভিনয়ে সাঁওতালরা৷ মহড়া চলছে বীরভূমের দ্বারোন্দা গ্রামে৷ থিয়েটার কটেজ থেকে খোঁজ নিলেন ইন্দ্রনীল শুক্লা


রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটক হিসেবে একটু আলাদা রকমের৷ নতুন সময়ের জানলা খুলে আগামীর দিকে তাকিয়েছেন তিনি৷ এখানে তিনি নাট্যকার তো বটেই, একজন দার্শনিক ও দ্রষ্টাও৷ এ নাটক যন্ত্রের বিরোধিতা করে না৷ বরং যন্ত্রের অবিশ্বাস্য ক্ষমতা, তার প্রয়োগ ও ফলাফল বিষয়ে মানুষকে হাজারো প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়৷ একজন বিশ্বনাগরিক হিসেবে রবি ঠাকুর সেই সময়ে সারা বিশ্বের প্রগতি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা ভারতবর্ষকে তীব্র ভাষায় সমালোচনাও করেন৷ তিনি বলেন, বহির্বিশ্বের প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলে আসলে আমরা প্রগতির উল্টো পথে হাঁটবো৷ তিনি এমনকী শান্তিনিকেতনে চাষের কাজের জন্য বিদেশ থেকে উন্নততর মেশিন আনার পরিকল্পনাও করেছিলেন৷ পাশাপাশি তিনি এও অনুভব করেন যে মানুষের লোভ ও দম্ভ যন্ত্রকে ভুলভাবে ব্যবহার করে আসলে আগ্রাসনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মানুষের দুর্ভোগ, ক্ষয়-ক্ষতি এবং হতাশার ছবি কবির বহু লেখার কারণ হয়ে ওঠে৷ ‘সভ্যতার সঙ্কট’ এবং ‘মুক্তধারা’ তার মধ্যে অন্যতম৷ এ হেন নাটক সাঁওতালি ভাষায় হতে চলেছে শুনে বিস্ময়ের উদ্রেগ স্বাভাবিক৷ আগামী ১৫ জানুয়ারি বীরভূমের ব্লসম থিয়েটার এটি মঞ্চস্থ করতে চলেছে তাদের থিয়েটার কটেজে৷ পরিচালনায় পার্থ গুপ্ত৷


এর আগেও তিনি সাঁওতাল উপজাতির মানুষদের নিয়ে ‘রক্তকরবী’ তৈরি করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘আরাবাহা’৷ ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা আয়োজিত ‘আদিবাসী-আদিবিম্ব’ উত্সবে তা মঞ্চস্থও হয়৷ আদিবাসীদের নিয়ে এভাবে সাঁওতালি ভাষায় একের পর এক রবি ঠাকুরের নাটক মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে জানতে হলে পার্থ’র জার্নিটা জানা জরুরি৷ বীরভূমের দ্বারোন্দা গ্রামের ছেলে৷ চেয়েছিলেন চিত্রকর হতে৷ কিন্ত্ত বিশ্বভারতীতে সুযোগ পেলেন না৷ অগত্যা পড়াশোনা শুরু করলেন নাটক নিয়ে৷ রতন থিয়ামের নাটকের প্রোডাকশনের ছবি ইন্টারনেটে দেখে ভাবনাটাই বদলে গেল৷ ‘ভাবলাম, যদি নাটক করতে হয় তবে এমন কিছুই করতে হবে, যেখানে প্রতিটা ফ্রেম হবে পেন্টিংয়ের মতো,’ বলছেন পার্থ৷ পরিচিত মানুষের সহায়তায় বেশ কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয় মণিপুরে রতন থিয়ামের কোরাস রেপার্টরিতে৷ পার্থ যেখানে বড় হয়েছেন, সেই দ্বারোন্দা এলাকায় ছাব্বিশটি সাঁওতাল গ্রাম রয়েছে৷ সহজেই তাদের সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন পার্থ৷ ২০১১ সালে এসে পড়ল একটা সুযোগ৷ সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ‘এনেক (নাচ) সেরেঙ (গান) পরব’ আয়োজিত হল৷ তখন পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীদের ব্যাপারে সমীক্ষার সুযোগ পেলেন পার্থ৷ কারণ, উত্সবে যোগ দিয়েছিলেন সাড়ে ছশো জন আদিবাসী পারফর্মার৷ বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার ছ’রকমের সাঁওতাল নাচের খোঁজ মিলল৷ বাহা, লাগরে, সোহরাই, ডং, দাঁসাই এবং করম৷ এর মধ্যে শেষ দু’টি ফর্ম কেবলমাত্র পুরুষ শিল্পীরাই পরিবেশন করে থাকেন৷ বাকি চারটে ফর্ম পরিবেশিত হয় পুরুষ-নারী মিলে৷ পার্থ বলছেন, ‘ওঁদের নাচ-গান দেখে ভাবতে লাগলাম যদি ওঁদের একটা নাটক থাকত, তবে তা কেমনভাবে ওঁদেরই ভাষায় প্রকাশিত হত৷ সেই ভাবনা থেকেই ‘মাটির ঘরের গান’ বা ‘হাঁসা ওঁরা রিয়া সেরেঙ’ নাটকটা তৈরি করি৷ সেই থেকেই ওদের নিয়ে কাজ করে আসছি৷’ এভাবেই ব্লসম থিয়েটার এগারো বছরে পড়ল৷

আর ‘মুক্তধারা’ কেমনভাবে তৈরি হল? পার্থ জানাচ্ছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের টেক্সটকে হুবহু সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ কর্ম করা হয়নি৷ বরং কনটেন্ট-এ জোর দেওয়া হয়েছে৷ সাঁওতালদের নৃত্যশৈলী, গান, সাজগোজ দিয়েই নাটকটা ডিজাইন করা হয়েছে৷’ পার্থ মনে করেন, ‘মুক্তধারা’র বাঁধ কেবলমাত্র নদীর জলের বাঁধ নয়৷ মানুষের জীবনের ভাবনা-চিন্তা-কাজের বহতাকেও তা আটকে রাখে৷ এরপর ‘রাজা’ নাটকটিও সাঁওতালদের নিয়ে করার পরিকল্পনা আছে পার্থর৷ ইচ্ছে আছে ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’ আর ‘রাজা’ ট্রিলজি হিসেবে ভবিষ্যতে পরিবেশন করবেন৷

কলকাতায় আসেন না কেন? ‘কেমন করে যাবো? জেলার দল, সাঁওতাল- এসব শুনলে হাতে চার-পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দিতে চায়৷ এই টাকায় তো শো করা সম্ভব নয়!’ বাঁধ অতএব রয়েই যাচ্ছে!

প্রয়াসের সাজঘরে বড়ো নাটকের উত্সব

$
0
0

সানি চট্টোপাধ্যায়
বর্ধমানে যে সমস্ত দলের নাম করলে নাট্যপ্রেমী মানুষ এক নামে চেনে , তাদের মধ্যে ‘বর্ধমান প্রয়াস ’ একটি৷ ১৯৯৯ সালে ছোটো নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের মাধ্যমে প্রয়াসের নাট্যচর্চার প্রথম প্রয়াস৷ নতুন দল প্রথমেই প্রথম হওয়ার আস্বাদ পেলে যেমন নৌকা পালে বাতাস পেয়ে যায় , তেমনই প্রয়াস ডাক পেতে থাকে বিভিন্ন নাটকের আসরে৷ বর্ধমানের মানুষও প্রয়াসের নাটক শুনে প্রেক্ষাগৃহে আসতে শুরু করে৷ প্রয়াস দলের হাতেখড়ি যাঁদের হাত ধরে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন উদয়শঙ্কর মুখোপাধ্যায় , কল্লোল চক্রবর্তী , তাপস চক্রবর্তী , পিঙ্কি সেনগুন্ত প্রমুখ ব্যক্তিত্ব৷

উদয়শংকর মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক অংশুমান কর রচিত ‘আমি ’ নাটকের মাধ্যমে প্রয়াস দলের শুভারম্ভ৷ তার পর থেকে প্রয়াসের উদ্যোগে বিভিন্ন বিখ্যাত নাটক যেমন , ‘অক্টোপাস লিমিটেড ’, ‘কাল বা পরশু ’, ‘পরাশরের পাসওয়ার্ড’, ‘খাঁচা ’, ‘এবং সীমান্ত ’ প্রভৃতি উপস্থাপিত হয়৷ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে প্রয়াসের নাটকগুলি অনেকবার প্রদর্শিত হয়েছে৷ এ বারে প্রয়াস দলটি আসছে বিরাট এক আয়োজন নিয়ে৷ এত দিন ছোটো নাটক করতে করতে কিছু ছোটো নাটকের উত্সবও হয়ে গেছে প্রয়াসের৷ এ বার পালা বড়ো নাটকের৷ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘সওদাগরের নৌকা ’ প্রযোজনার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়াস নিয়ে এল তিনদিন ব্যাপী বড়ো নাটক উত্সবের আসর ‘প্রয়াস সাজঘর নাট্য উত্সব ’৷ বর্ধমানের নাট্যচর্চার ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান সংস্কৃতি লোকমঞ্চে এপ্রিলের ২৮ , ২৯ , ৩০ তারিখে এই উত্সবটি আয়োজিত হবে৷ প্রথম দিন আসছে কলকাতার চেতনা প্রযোজিত বিজয় তেন্ডুলকর রচিত নাটক ‘ঘাসীরাম কোতয়াল ’৷

সম্পাদনা , নির্দেশনা ও অভিনয়ে রয়েছেন সুজন মুখোপাধ্যায় (নীল)৷ দ্বিতীয় দিন বর্ধমান প্রয়াসের নিজের নাটক ‘সওদাগরের নৌকা ’৷ এর সম্পাদনা , প্রয়োগ ও অভিনয়ে রয়েছেন উদয়শংকর মুখোপাধ্যায়৷ শেষ দিন রয়েছে হালিশহর ইউনিটি মালঞ্চ প্রযোজিত রজত ঘোষ রচিত নাটক ‘নটী বিনোদিনী ’৷ নাটকটির সম্পাদনা , পরিচালনা ও অভিনয়ে রয়েছেন দেবাশিস সরকার৷ বর্ধমানে নাটকের উত্সব যত বেশি পরিমাণে আয়োজিত হবে , তত বর্ধমানে সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ বাড়বে এবং বর্ধমান সমৃদ্ধ হবে শিল্প -সংস্কৃতিতে৷ ফলে সিনেমা তো রইলই , বর্ধমানবাসীর কাছে আবেদন ভিন্ন স্বাদের বিনোদনকেও আস্বাদ করুন৷ তা হলে বর্ধমানও একদিন অন্যান্য বড়ো শহরের মতো সংস্কৃতিচর্চায় ভারতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে৷ সানি চট্টোপাধ্যায়বর্ধমানের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারেন এই বিভাগে৷ খামের উপরে বা ই -মেলে সাবজেক্টে লিখবেন ‘সাংস্কৃতিকী , বর্ধমান সমাচার ’৷

সত্তরে বহুরূপী

$
0
0

আগামী ১ মে সত্তর বছরে পা রাখতে চলেছে বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠী৷ এমন ঘটনা যে কোনও নাট্যদলের কাছেই বিরল সম্মানের ব্যাপার৷ এতদূর পথ চলা তো চাট্টিখানি কথা নয়৷ একটু পিছিয়ে গিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে৷ ১৯৪৮ সাল৷ স্বাধীনতার তখনও এক বছরও পেরোয়নি৷ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, অশোক মজুমদার, গঙ্গাপদ বসু, তৃন্তি মিত্র, কুমার রায় প্রমুখ কয়েকজন মিলে এক জায়গায় বসে ঠিক করেছিলেন, মঞ্চের উপর এমন একটা কিছু করে ওঠা চাই যা থেকে বাংলা তথা ভারতের আত্মাকে ধরা যাবে, যা দেখে মনে হবে না যে এটা আমাদের দেশের কথা নয়, বা এর সঙ্গে আমাদের নাড়ির যোগ নেই৷

স্বাধীনতা উত্তর ভারতের তখন বেশ টালমাটাল অবস্থা৷ সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কতি তখনও হাতড়ে মরছে একটা সুস্থির লক্ষ্যে পৌঁছাতে৷ আর এই অস্থির সময়েই কিছু তরতাজা যুবককে সঙ্গে নিয়ে কয়েকজন প্রবীণ মিলে গড়ে তোলেন বহুরূপী৷ তৈরির পর্বটা কিন্ত্ত বেশ অনিশ্চয়তাতেই কেটেছে৷ জমি প্রস্ত্তত ছিল না৷ ফসল কেমন উঠবে জানা ছিল না, উঠলেও মানুষের কাছে তা কী বার্তা এনে দেবে, এসব কিছুই জানা ছিল না৷ কিন্ত্ত শুরুটা হয়ে যাওয়ার পর সেই দলই বাংলা নাটকের তথা সংস্কতির একটা বড়সড় জায়গা দখল করে ফেলল মানুষের ভালোবাসায়৷ নাট্যপ্রেমী মানুষ বহুরূপীর ভাবনার প্রতি, দূরদৃষ্টির প্রতি, সমাজচেতনার প্রতি আস্থা রাখলেন৷ এবং বহুরূপী শহর ছাড়িয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারলো মফস্বল, গ্রামেও৷

অ্যাকাডেমিতে আগামী ২৯ এপ্রিল থেকে ১ মে বহুরূপীর নাট্যোত্সব অনুষ্ঠিত হতে চলেছে৷ এই উত্সবের অঙ্গ হিসেবে বহুরূপী ৭০ বছর অতিক্রান্ত সাতজন নাট্যব্যক্তিত্বকে সম্মান জানাতে চলেছে৷ এঁরা হলেন, মনোজ মিত্র, অরুণ মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুন্ত, হরিমাধব মুখোপাধ্যায়, অশোক মুখোপাধ্যায় ও পঙ্কজ মুন্সি৷ সম্মাননা জ্ঞাপন করা হবে রাজনীতিতে বাংলা সংস্কতির একনিষ্ঠ সংগঠক, পরিপোষক ও পৃষ্ঠপোষক বিজন মুখোপাধ্যায়কে৷ এছাড়াও অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সাউথ গ্যালারিতে আয়োজন করা হয়েছে বাংলা নাট্যের ক্রমবিকাশের অভিমুখ ও নাট্য সম্পর্কিত প্রদর্শনীর৷ আর হ্যাঁ, নাটক তো অবশ্যই থাকছে উত্সবে৷ উত্সবের অতিথি দল ভুবনেশ্বরের নাট্যচেতনা৷ সুবোধ পট্টনায়কের পরিচালনায় অভিনীত হবে 'নিয়ান'৷ অপর অতিথি দল পাটনার আইপিটিএ নিয়ে আসছে তনভীর আখতার পরিচালিত 'গবরঘিচোরন কে মাঈ' (সঙ্গের ছবি)৷ সঙ্গে রয়েছে বহুরূপীর তিনটি পুরনো প্রযোজনা: কুমার রায় পরিচালিত 'ফুল্লকেতুর পালা', দেবেশ রায়চৌধুরী পরিচালিত 'নানা ফুলের মালা' ও 'আত্মঘাতী'৷ উল্লেখ্য, এই উত্সবেই বহুরূপী প্রথমবারের জন্য মঞ্চস্থ করবে তাদের দলের নতুন নাটক 'মেডেল'৷ পরিচালনায় দেবেশ রায়চৌধুরী৷ দলের তরফে জানানো হয়েছে যে তাঁদের বিশ্বাস অন্যান্যবারের মতোই এবারও মানুষ বহুরূপীর উত্সবে স্বতঃস্ফর্তভাবে যোগদান করে উত্সবকে সার্থক করে তুলবেন৷

-ইন্দ্রনীল শুক্লা


ভয়ের উত্সে নাটকীয় আঘাত

$
0
0

ব্লগার খুন৷ শ্রীজাত-র কবিতা৷ সেই ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’তে সুর দিলেন শ্রীকান্ত৷ পাঠে ব্রততী৷ দেবেশের পরিচালনা৷ খোঁজ নিলেন ইন্দ্রনীল শুক্লা

প্রতিবেশী রাষ্ট্রে একটা খুন! আর তার প্রেক্ষিতে হঠাত্ করেই কিছু পংক্তি লিখে ফেলেছিলেন শ্রীজাত৷ পোস্ট করে দিয়েছিলেন ফেসবুকে৷ কী সেই ঘটনা? একটু পিছিয়ে যেতে হবে৷ ২০১৫ সাল৷ তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি৷ স্থান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের বইমেলা প্রাঙ্গণ৷ সময় রাত আটটা৷ বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন সস্ত্রীক অভিজিত্ রায়৷ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্লগ লেখেন তিনি৷ বার বার প্রাণনাশের হুমকির পরেও ধর্মান্ধতাকে তুলোধোনা করতে পিছপা হন না৷ কিছু বোঝার আগেই কয়েকজন ঘিরে ফেললেন অভিজিত্ আর তাঁর স্ত্রীকে৷ অভিজিত্কে কোপানো হল চপার দিয়ে৷ দেহ ফালাফালা হল৷ রক্তে নদী৷ তিনি মারা গেলেন ঘটনাস্থলেই৷ মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তাঁর স্ত্রীকে৷ কিন্ত্ত শুধু অভিজিত্ই নন৷ ক্রমে আহমেদ রাজীব হায়দার, সুননুর রহমান, শফিউল ইসলাম, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, নরেন্দ্র দাভেলকর, গোবিন্দ পানসারে, প্রফেসর কুলবর্গি... তালিকাটা ক্রমেই বাড়তে থাকল৷ আর শ্রীজাত-র কবিতার সংখ্যাও বেড়ে যেতে লাগল৷ শেষে গত বইমেলার গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’৷ ৫২টি কবিতা৷ আর এই কাব্যগ্রন্থকেই এবার মঞ্চ উপস্থাপনায় নিয়ে আসতে চলেছে বেলঘড়িয়া শঙ্খমালা৷

দলের কর্ণধার সুমন্ত্র সেনগুপ্ত’র থেকে জানা গেল প্রযোজনায় ব্যবহূত হচ্ছে ৩২টি কবিতা৷ বাচিক শিল্প, থিয়েটার ও সঙ্গীতের সমন্বয়ে এক নিরীক্ষা৷ গত ২৫ বছর ধরেই বাচিক শিল্পে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছে শঙ্খমালা৷ এটিও তেমনই এক প্রয়াস৷ সমগ্র প্রোডাকশনটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়৷ পাঠে সুমন্ত্র ছাড়াও অংশ নেবেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীজাত ও দলের শিল্পীরা৷ সংগীত সামলেছেন শ্রীকান্ত আচার্য৷

শ্রীজাত বলছেন, ‘একই লোকের লেখা, একই বিষয়ের উপর এতগুলো কবিতা কেমন লাগবে তা নিয়ে প্রথমে চিন্তায় ছিলাম৷ কিন্ত্ত দেবেশদা এমনভাবে কবিতাগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে মঞ্চরূপ দিয়েছেন যে খুব অন্য রকম লাগছে৷ তাছাড়া আমিও নিছক পাঠ করছি না৷ আংশিকভাবে অভিনয়ও করতে হচ্ছে৷ তাই নতুনত্ব রয়েছে৷’

গোটা দশেক কবিতা পাঠ করছেন ব্রততী৷ কিন্ত্ত আংশিক অভিনয় করতে হচ্ছে তাঁকেও৷ এ রকম ডিজাইনের প্ল্যানটা সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় দেবেশ বলছেন, ‘সন্ত্রাসের বাতাবরণ এবং তার মধ্যে নীরব হয়ে থাকার ভয়াবহতাটা তুলে ধরতে চেয়েছি৷ ভয়ানক কিছু ঘটতে দেখেও প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে থাকা মারাত্মক ব্যাপার৷ অথচ সেটাই ঘটছে বাস্তবে৷ এই সব কিছু মিলিয়েই সার্বিক ছবি আঁকা হচ্ছে মঞ্চে৷’

শ্রীকান্ত আচার্য জানাচ্ছেন, এই প্রোডাকশনের তিনি সঙ্গীত পরিচালক এ রকম বললে ঠিক বোঝানো যাবে না৷ ব্যাখ্যা করে বলছেন, ‘বলা ভালো আমি আবহ তৈরি করেছি৷ চালচিত্র তৈরি করেছি৷ কবিতাগুলোর উপস্থাপনকে কমপ্লিমেন্ট করতে পারে এমন গান বাছা হয়েছে৷ কবীরের ভজন, লালনের গান, বব ডিলানের ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’-এমন অনেক কিছুই থাকছে৷ ন্যাচরাল সাউন্ডও ব্যবহার করা হচ্ছে৷’

উপস্থাপনায় যে নতুনত্ব রাখা হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে দেবেশ বলছেন, ‘কবিতা নিয়ে কাজ করার প্রবণতা আমার অনেকদিনই ছিল৷ বিবেকান্দকে নিয়ে ওঁদের দলের জন্য ‘বীরেশ্বর’-এর কাজ করি৷ শ্রীজাত-র কবিতা নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব যখন সুমন্ত্র দিল, উত্সাহিত বোধ করলাম৷ মনে হল কবিতাগুলোর জন্য মঞ্চে আলাদা আলাদা রকমের ভিস্যুয়াল তৈরি করা যাক৷ শ্রীজাত, ব্রততী যাঁরা কবিতা নিয়মিত পড়েন কিন্ত্ত অভিনয় করতে হয় না, তাঁদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছি কবিতাগুলোরই প্রয়োজনীয় মুহূর্ত গড়ার তাগিদে৷’

শব্দে, গানে, আলোয়, অভিব্যক্তিতে কবিতার মুহূর্ত কেমন তৈরি হল তা দেখতে অপেক্ষা সামান্যই৷ ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ মঞ্চস্থ হবে আগামী ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায়, কলামন্দিরে৷

সিপিএম-সিপিএম প্রেম

$
0
0

সাক্ষী যখন মঞ্চ ! সৌরভ পালোধী আর তূর্ণা দাস৷ লিখছেন ভাস্বতী ঘোষ

হাতে সময় দিন তিরিশ৷ তারপরই প্রেমের উত্সবে গা ভাসাবে এ শহর৷ তাই এই মরশুমে শহরে ঘটে যাওয়া জমজমাট প্রেমের কাহিনির খোঁজে বেরিয়েছিলাম৷ প্রথমেই চোখ আটকাল মঞ্চে ! এ প্রেমে যে নাটকীয়তা থাকবে , সে কি আর বলে দিতে হবে ? প্রেমিকের নাম সৌরভ পালোধী৷ আর তাঁর প্রেমিকাটির নাম তূর্ণা দাস বলেই , অনেক পুরুষের হূদয়ে হালকা ধাক্কা ! নাটকের মঞ্চে তূর্ণা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ৷ অনেকদিন ধরেই অবশ্য চুটিয়ে মন দেওয়া -নেওয়ার পালা চালিয়েছেন দু’জনে৷ আর এবার বিয়ের পিঁড়িতে৷

সৌরভ এমনিতে টালিগঞ্জের পরিচিত মুখ৷ তবে তূর্ণা দাস -এর ফ্যানফলোয়িং কি একটু বেশি ? সৌরভ নিজেই তো স্বীকার করে নিচ্ছেন সে কথা৷ অনর্গল বলতে লাগলেন , ‘দিনটা মনে আছে৷ ২০১৪ -র ১০ মে৷ অ্যাকাডেমিতে আমার নাটক চলছিল৷ তূর্ণা দেখতে এসেছিল৷ আমি কিন্ত্ত তার বহু আগে থেকেই নাটকের মঞ্চের তূর্ণা দাসের ফ্যান৷ ওর সঙ্গে যে জায়গায় আলোচনা জমল , সেটা পলিটিক্যাল নাটক নিয়ে৷ পলিটিক্যাল নাটক শহরে কম হয় , তা নিয়ে তূর্ণার একটা ক্ষোভ ছিল৷ সেই জায়গায় আমি পয়েন্ট স্কোর করলাম ‘বুদ্ধিজীবী ’ বানিয়ে৷ আমাদের প্রেমটা সিপিএম -সিপিএম প্রেম৷ তূর্ণা আমায় জিজ্ঞেস করেছিল , ‘তুমি কি নকশাল ’? উত্তরে আমি বলি , ‘আমি তো চিরকালই এসএফআই ’৷ এরপর থেকে বন্ধুত্ব গাঢ় হল৷ আমার ‘ইচ্ছেমতো ’ দলে তূর্ণা বড় ভূমিকা পালন করতে শুরু করল৷ ’ এমনিতে তূর্ণা সৌরভের চেয়ে সাড়ে তিন বছরের বড়৷ তূর্ণা-ও হেসে বলছেন , ‘আসলে আমাদের মধ্যে ঝগড়াটাই বেশি হয়৷ মানে আমরা মারপিট -ও করি আরকী ! কারণ আমরা ভয়ঙ্কর ভালো বন্ধু৷ সৌরভ আসলে গৌতম হালদারের অন্ধ ভক্ত৷ আমি যখন ‘আরব্য রজনী ’ নাটক করছি , ও তখন গৌতম হালদারকে দেখতে রোজ আসত৷ আর যতবার আসত , ততবার মঞ্চেআমায় দেখত৷ ’এই নাটকের মঞ্চের প্রেমের তীব্রতা এতটাই , যে সৌরভ আর তূর্ণা সাতপাকে বাঁধা পড়ছেন এই শীতেই৷ কিন্ত্ত প্রেম হলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তো নয় ! বরং বিয়ে সামালাতে হিমশিম হওয়ার আশঙ্কা৷ তা হলে ? সৌরভ বলছেন , ‘এখন যে যার নিজের বাড়ি যাই৷ বিয়ের পর একবাড়িতে ফিরব৷ এর বাইরে আর তো কিছু আলাদা নেই ! এখন আমরা যেভাবে আছি , সেরকমভাবেই থাকব৷ আসলে আমাদের অধিকাংশ সময় নাটকের দল ‘ইচ্ছেমতো ’ নিয়েই কাটে৷ আমাদের বিয়ের পিছনেও দলের সদস্যদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে৷ অনেকে জিজ্ঞেস করছেন হানিমুনে আমরা দু’ জন কোথায় যাব৷ এখন তাঁদের এটাই বোঝাতে হবে , যে আমরা দু’ জন মিলে কোথাও যাব না৷ দলের সব সদস্যরা মিলেই যাব!’

এই প্রেম হল কী খেয়ে ? সৌরভ হেসে বলছেন , ‘চাইনিজ রেস্তোরাঁয় গিয়ে যে দু’ জনে মিলে খাইনি তা নয়৷ আবার যদি এরকম হয় যে , ফুচকা খেয়েই প্রেম করতে হবে , তা হলে আর এ প্রেম হত না ! বরং এই প্রেমে বেশি খাওয়া হয়েছে রুটি আর আলুরদম৷ রিহার্সালের সময়৷ ’ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করেন না এই প্রেমিক -প্রেমিকা৷ তাই এই শীতে কলমের সইয়ে তাঁরা একে -অন্যের হবেন , ইচ্ছে সেরকমই৷ আর তারপর বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে জমিয়ে খাওয়া -দাওয়া তো আছেই ! তারিখ জানুয়ারি ২২৷ তবে টিকিট কেটে সেই শো আপনি দেখতে চাইলেও , দেখতে পাবেন না৷ এদিন সৌরভ আর তূর্ণা মঞ্চে আসবেন , একে -অন্যের জন্য !

এই ‘মুক্তধারা’ ভাঙবে শহুরে বাঁধ?

$
0
0

রবি ঠাকুরের ‘মুক্তধারা’৷ অভিনয়ে সাঁওতালরা৷ মহড়া চলছে বীরভূমের দ্বারোন্দা গ্রামে৷ থিয়েটার কটেজ থেকে খোঁজ নিলেন ইন্দ্রনীল শুক্লা


রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটক হিসেবে একটু আলাদা রকমের৷ নতুন সময়ের জানলা খুলে আগামীর দিকে তাকিয়েছেন তিনি৷ এখানে তিনি নাট্যকার তো বটেই, একজন দার্শনিক ও দ্রষ্টাও৷ এ নাটক যন্ত্রের বিরোধিতা করে না৷ বরং যন্ত্রের অবিশ্বাস্য ক্ষমতা, তার প্রয়োগ ও ফলাফল বিষয়ে মানুষকে হাজারো প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়৷ একজন বিশ্বনাগরিক হিসেবে রবি ঠাকুর সেই সময়ে সারা বিশ্বের প্রগতি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা ভারতবর্ষকে তীব্র ভাষায় সমালোচনাও করেন৷ তিনি বলেন, বহির্বিশ্বের প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলে আসলে আমরা প্রগতির উল্টো পথে হাঁটবো৷ তিনি এমনকী শান্তিনিকেতনে চাষের কাজের জন্য বিদেশ থেকে উন্নততর মেশিন আনার পরিকল্পনাও করেছিলেন৷ পাশাপাশি তিনি এও অনুভব করেন যে মানুষের লোভ ও দম্ভ যন্ত্রকে ভুলভাবে ব্যবহার করে আসলে আগ্রাসনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মানুষের দুর্ভোগ, ক্ষয়-ক্ষতি এবং হতাশার ছবি কবির বহু লেখার কারণ হয়ে ওঠে৷ ‘সভ্যতার সঙ্কট’ এবং ‘মুক্তধারা’ তার মধ্যে অন্যতম৷ এ হেন নাটক সাঁওতালি ভাষায় হতে চলেছে শুনে বিস্ময়ের উদ্রেগ স্বাভাবিক৷ আগামী ১৫ জানুয়ারি বীরভূমের ব্লসম থিয়েটার এটি মঞ্চস্থ করতে চলেছে তাদের থিয়েটার কটেজে৷ পরিচালনায় পার্থ গুপ্ত৷


এর আগেও তিনি সাঁওতাল উপজাতির মানুষদের নিয়ে ‘রক্তকরবী’ তৈরি করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘আরাবাহা’৷ ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা আয়োজিত ‘আদিবাসী-আদিবিম্ব’ উত্সবে তা মঞ্চস্থও হয়৷ আদিবাসীদের নিয়ে এভাবে সাঁওতালি ভাষায় একের পর এক রবি ঠাকুরের নাটক মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে জানতে হলে পার্থ’র জার্নিটা জানা জরুরি৷ বীরভূমের দ্বারোন্দা গ্রামের ছেলে৷ চেয়েছিলেন চিত্রকর হতে৷ কিন্ত্ত বিশ্বভারতীতে সুযোগ পেলেন না৷ অগত্যা পড়াশোনা শুরু করলেন নাটক নিয়ে৷ রতন থিয়ামের নাটকের প্রোডাকশনের ছবি ইন্টারনেটে দেখে ভাবনাটাই বদলে গেল৷ ‘ভাবলাম, যদি নাটক করতে হয় তবে এমন কিছুই করতে হবে, যেখানে প্রতিটা ফ্রেম হবে পেন্টিংয়ের মতো,’ বলছেন পার্থ৷ পরিচিত মানুষের সহায়তায় বেশ কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয় মণিপুরে রতন থিয়ামের কোরাস রেপার্টরিতে৷ পার্থ যেখানে বড় হয়েছেন, সেই দ্বারোন্দা এলাকায় ছাব্বিশটি সাঁওতাল গ্রাম রয়েছে৷ সহজেই তাদের সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন পার্থ৷ ২০১১ সালে এসে পড়ল একটা সুযোগ৷ সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ‘এনেক (নাচ) সেরেঙ (গান) পরব’ আয়োজিত হল৷ তখন পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীদের ব্যাপারে সমীক্ষার সুযোগ পেলেন পার্থ৷ কারণ, উত্সবে যোগ দিয়েছিলেন সাড়ে ছশো জন আদিবাসী পারফর্মার৷ বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার ছ’রকমের সাঁওতাল নাচের খোঁজ মিলল৷ বাহা, লাগরে, সোহরাই, ডং, দাঁসাই এবং করম৷ এর মধ্যে শেষ দু’টি ফর্ম কেবলমাত্র পুরুষ শিল্পীরাই পরিবেশন করে থাকেন৷ বাকি চারটে ফর্ম পরিবেশিত হয় পুরুষ-নারী মিলে৷ পার্থ বলছেন, ‘ওঁদের নাচ-গান দেখে ভাবতে লাগলাম যদি ওঁদের একটা নাটক থাকত, তবে তা কেমনভাবে ওঁদেরই ভাষায় প্রকাশিত হত৷ সেই ভাবনা থেকেই ‘মাটির ঘরের গান’ বা ‘হাঁসা ওঁরা রিয়া সেরেঙ’ নাটকটা তৈরি করি৷ সেই থেকেই ওদের নিয়ে কাজ করে আসছি৷’ এভাবেই ব্লসম থিয়েটার এগারো বছরে পড়ল৷

আর ‘মুক্তধারা’ কেমনভাবে তৈরি হল? পার্থ জানাচ্ছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের টেক্সটকে হুবহু সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ কর্ম করা হয়নি৷ বরং কনটেন্ট-এ জোর দেওয়া হয়েছে৷ সাঁওতালদের নৃত্যশৈলী, গান, সাজগোজ দিয়েই নাটকটা ডিজাইন করা হয়েছে৷’ পার্থ মনে করেন, ‘মুক্তধারা’র বাঁধ কেবলমাত্র নদীর জলের বাঁধ নয়৷ মানুষের জীবনের ভাবনা-চিন্তা-কাজের বহতাকেও তা আটকে রাখে৷ এরপর ‘রাজা’ নাটকটিও সাঁওতালদের নিয়ে করার পরিকল্পনা আছে পার্থর৷ ইচ্ছে আছে ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’ আর ‘রাজা’ ট্রিলজি হিসেবে ভবিষ্যতে পরিবেশন করবেন৷

কলকাতায় আসেন না কেন? ‘কেমন করে যাবো? জেলার দল, সাঁওতাল- এসব শুনলে হাতে চার-পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দিতে চায়৷ এই টাকায় তো শো করা সম্ভব নয়!’ বাঁধ অতএব রয়েই যাচ্ছে!

শেক্সপিয়রের অ্যাডাপটেশন! হয় নাকি?

$
0
0

দেশজুড়ে খ্যাতি থিয়েটার নির্দেশক এবং অভিনেতা হিসেবে৷ কিন্তু পদ্মশ্রী আমির রাজা হুসেন মঞ্চে উঠলে আজও কাউকে এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দিতে পারেন না৷ এমনকি নিজের পুত্রকেও৷ শহরে ঝটিকা সফরে এসে বললেন দেবলীনা ঘোষ মুখোপাধ্যায়কে


শহরে এসেছিলেন আমির রাজা হুসেন৷ তাঁর নতুন নাটক ‘ওয়ান্স আপন আ মার্ডার’ মঞ্চস্থ করতে৷ কলকাতায় থাকলেনও প্রায় এক সপ্তাহ৷ কিন্ত্ত হোটেল থেকে বেরোনো হল না তাঁর৷ কারণ রিহার্সল৷ দম ফেলার ফুরসত্ নেই৷ তবুও তারই ফাঁকে সময় দিলেন৷


তিনি তুখোড় অভিনেতা৷ কিন্ত্ত সে কথা তো জানা৷ পদ্মশ্রীও তাঁর ঝুলিতে৷ সে খবরেই বা নতুনত্ব কোথায়? এবার তিনি কথা বললেন কিছু অন্য বিষয় নিয়ে৷ সাহিত্য থেকে পরিবার, রাজনীতি থেকে রেষারেষি-কিছুই বাদ গেল না৷

রাজনীতি এবং…

রাজনীতি করতে গিয়ে আমি বুঝেছি এটা আমার সঠিক জায়গা নয়৷ কারণ রাজনীতি করলে মনের কথা খুলে বলা যায় না৷ ঠিক কথা বলতে গেলে অনেক সমস্যার মুখামুখি হতে হয়৷ তাই রাজনীতিতে আর নয়৷ কারও ওপর কোনও ক্ষোভ নেই৷ বিষয়টা ভালো না খারাপ, তা নিয়েও মন্তব্য করতে চাই না৷ শুধু আমার দ্বারা হবে না৷ ব্যস৷

শহরনামা

কলকাতার বিষয়ে আমি বিশেষ কিছুই জানি না৷ এই যে শো করতে এসেছি, পাঁচতারা হোটেলে কেবল মহড়াই দিয়ে যাচ্ছি৷ জানিই না বাইরে কী হচ্ছে৷ বা কলকাতার কোথায় কী আছে৷ শহর ঘুরে দেখার ইচ্ছে থাকলেও সময় কই? আর নাটকটা তো সঠিকভাবে মঞ্চস্থ করতে হবে৷ সেটাই আমার কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ৷

কলকাতার নাটক

এই প্রশ্নটা আমাকে লজ্জায় ফেললো৷ কারণ কলকাতার নাটক সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না৷ এখানে কীরকম কাজ হচ্ছে, কী ধরনের স্টেজ হচ্ছে, সংলাপ কেমন, মিউজিক কেমন, আলো কেমন-কিচ্ছু জানি না৷ কলকাতার কোনও নাটকের দলের সঙ্গেও পরিচয় নেই৷ কলকাতায় নাটক হয় জানি৷ তা বলে শহরে এসেছি বলেই বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলতে পারব না৷

ক্ল্যাসিকের পুণর্নির্মাণ

আমি আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাস নিয়ে নাটক করেছি৷ শেক্সপিয়রেরও অনেক নাটক মঞ্চস্থ করেছি৷ কিন্ত্ত আমি সেগুলোর ওপর কলম চালাইনি৷ বা খুব নতুনত্ব কিছু করব ভেবে একেবারে প্রেক্ষাপটটাই বদলে দিইনি৷ এখন অনেকে এরকম করেন৷ বলেন শেক্সপিয়ারের কোনও লেখার অ্যাডাপটেশন৷ এটা সম্ভব? আমার তো মনে হয় না কোনও ক্ল্যাসিক আবার নতুন করে ভেবে ইম্প্রোভাইজ করা যেতে পারে৷ বা অন্যরকম করা যেতে পারে৷ তাহলে সেগুলো তো ওই পর্যায়ে যেতই না৷

কমেডি প্রেম

আমার প্রিয় জ্যঁর হচ্ছে কমেডি৷ হাস্যরস ছাড়া জীবন একেবারে আলুনি৷ আমাকে দেখে হয়তো মনে হয় হাসতে জানি না, সবসময় সিরিয়াস বিষয় নিয়েই চিন্তা করি৷ এমনটা একেবারেই নয়৷ হাসা এবং হাসানো কোনওটাই সহজ কাজ নয়৷ তবে ভাঁড়ামো পছন্দ নয়৷ আমি অনেক সমসাময়িক, জটিল বিষয়ও কমেডির মাধ্যমে সহজ করে বলতে পারি৷ মানুষও বুঝতে পারেন সহজে৷ কারও ভাবনাতেও আঘাত করা হয় না৷ আবার বিষয়টা বলাও হয়ে যায়৷ তাই কমেডির থেকে জোরালো মাধ্যম আর কিছু নেই৷

পারিবারিক প্রতিযোগিতা

নতুন নাটকটা (যেটা কলকাতায় মঞ্চস্থ হল) আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ আমার ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী আর আমি-চারজনই অভিনয় করছি৷ নাটকটা আমারই লেখা এবং নির্দেশনা৷ একসঙ্গে পুরো পরিবার নানা জায়গায় ঘুরে অভিনয় করছি, এটাই দারুণ মজার৷ তাই যখন এখটি ফোন সংস্থা প্রযোজনা করবে বলে, রাজি হয়ে যাই৷
অভিনয় করার সময় আমি কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়ি না৷ তখন ভুলে যাই সহ অভিনেতা আমার স্ত্রী, পুত্র বা কন্যা৷ ভুলে যাই আমার পদ্মশ্রী পাওয়া হয়ে গিয়েছে৷ এত বছর, এতগুলো নাটক, ফিল্ম করা হয়ে গিয়েছে৷ দর্শকদের হাততালির এক অন্যরকম নেশা রয়েছে৷ সে নেশা যাওয়ার নয়৷ যতক্ষণ রিহার্সল করছি ততক্ষণ আমাকে যত প্রশ্ন কর উত্তর দেব৷ যে সাহায্য চাও অভিনয় নিয়ে, করব৷ কিন্ত্ত মঞ্চে আমার আলাদা অস্তিত্ব৷ অনেক সময় তাত্ক্ষণিক কিছু ইমপ্রোভাইজেশনও করি৷ সব অভিনেতারাই করেন৷ তখন কিন্ত্ত আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয়টা করতে হবে৷ বলতে দ্বিধা নেই আমার পরিবারের সবাই খুব ভালো অভিনেতা৷

নাটক আর রোল

$
0
0

রোল বলতে চরিত্র নয়, চিকেন রোল৷ শহরে রয়েছেন মকরন্দ দেশপাণ্ডে৷ নাটকের মহড়া দিতে৷ তার ফাঁকেই আড্ডা দিলেন দেবলীনা ঘোষ মুখোপাধ্যায়

কলকাতার সব থেকে প্রিয় কী: প্রথমেই বলব রোল-এর কথা৷ কলকাতার চিকেন রোল, মটন রোলের কোনও তুলনা হয় না৷ আমি এই নিয়ে চারবার কলকাতায় আসছি৷ প্রতিবারই ভাবি পৌছেই রোল অর্ডার করব৷ কলকাতা শহরের একটা পুরনো ব্যাপার রয়েছে৷ শহরটা একটা ফোটোগ্রাফের মতো৷ শিল্প নিয়ে একটা প্যাশনেট টেনশন কাজ করে এই শহরে৷ সব জায়গায় সেটা পাওয়া যায় না৷ আর একটা জিনিসও বলব৷ এখানকার মানুষরা সিগারেট ঠোঁঠে ঝুলিয়ে যে ইন্ট্যালেকচুয়াল আলোচনা করেন সেটার কোনও তুলনা নেই৷ আমি কিন্ত্ত সিগারেট খাওয়ার পক্ষে নই৷ কিন্ত্ত এভাবে যে দৃশ্যটা তৈরি হয় আমার কোনও এক নাটকে সেটা ব্যবহার করার খুব ইচ্ছে রয়েছে৷

নতুন নাটক: এই নাটকের নাম 'মা ইন ট্রানজিট'৷ 'জি থিয়েটার'কে আমি ধন্যবাদ জানাব বিভিন্ন শহরের নাটক দর্শকদের দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য৷ এটা মা এবং ছেলের সম্পর্কের গল্প৷ মা মারা যাওয়ার পর অন্য জগতে তখনও পৌঁছায়নি৷ কিন্ত্ত ইহ জগতেও আর নেই৷ এই ট্রানসিটে মায়ের সঙ্গে ছেলে দেখা করে৷ এটা একটা মেটাফিজিক্যাল গল্প৷ কিন্ত্ত সহজভাবে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া৷ একটা ফ্যান্টাসি আছে৷ কিন্ত্ত একটা সত্যিকারের বেসও রয়েছে৷

কলকাতার নাটক: নাটক করি অথচ কলকাতার নাটক নিয়ে জানবো না তাও কী হয়৷ আমার খুব ইচ্ছে সোহিনি সেনগুন্ত, স্বাতিলেখা সেনগুন্ত, গৌতম হালদারের নাটক দেখার৷ নান্দীকার ফেস্টিভ্যালে আমার কখনও আসা হয়নি৷ এটা খুব বড় আক্ষেপ৷ নতুন আরও অনেকে নাটক নিয়ে ভালো কাজ করছেন, খবর পাই৷ বাদল সরকার, শম্ভু মিত্রকে না জানলে আর যাই হোক নাটকটা হবে না৷ মহারাষ্ট্রের মতো কলকাতাতেও এত ভালো কাজ হয় বলেই তো এখানে বারবার ফিরে আসি৷ ভোপাল, দিল্লির কিছু কিছু জায়গাতেও খুব ভালো নাটক হয়৷ এই পকেটগুলোই নাটককে বাঁচিয়ে রেখেছে৷

এখনকার বলিউড ফিল্ম: ভালো কাজ সবসময়ই হয়৷ কিন্ত্ত আগে ফান্ডিং পাওয়া যেত না৷ এখন যেমন অনেক কর্পোরেট কোম্পানিও এগিয়ে আসে ফান্ডিং-এর জন্য৷ এখন বক্স অফিস হিট আর ভালো ফিল্ম-এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই৷ যেমন আমির খানের ছবি৷ প্রত্যেকটার বিষয়ই খুব ভালো আবার দারুণ সফলও৷ এই ব্যাপারটাই ভালো লাগে৷

ব্যক্তিগত জীবন: এখন আর আলাদা করে কিছু নেই৷ আমার পুরোটাই একটা জীবন হয়ে গিয়েছে৷ নানা শহরে টু্যর করি৷ তার মধ্যে থেকেই সময় বের করে নিয়ে রেস্তোরাঁয় খাই, ঘুরে বেড়াই৷ আবার কখনও শু্যটিং করি৷ রিহার্সালের ফাঁকে ঘুমিয়ে নিয়ে৷ স্নান করতে করতে ডায়লগ বলি৷ তাই আমার দুটো সত্ত্বা নেই৷ পুরোটা সত্ত্বা জুড়েই অভিনয়৷

নতুনদের জন্য: নিজেদের রিজেকশনের জন্য সবার আগে প্রস্ত্তত হতে হবে৷ কেউ নাকচ করে দিলে ভেঙে পড়লে চলবে না৷ অভিনয়ের মূল কথা কিন্ত্ত ধৈর্য৷ সেটা হারালে হবে না৷ আর যে যাই বলুক, যত নিন্দেই করুক, অভিনয়টা করে যেতে হবে৷ কারণ ওটা প্র্যাকটিসের মতো৷ যত বেশি অভ্যেস করবে তত ভালো হবে৷


বিদেশি শুনেই কাঁধ ঝুঁকিয়ে নেব কেন?

$
0
0

কেবল রাজ বব্বরের স্ত্রী কিংবা আর্য বব্বরের মা, এটা তাঁর পরিচয় হতে পারে না। নাদিরা জাহির বব্বর দেশের অন্যতম নামী নাট্যব্যক্তিত্ব। শহরে এসেছিলেন এক থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এ। তখনই তাঁর মুখোমুখি। কথা বললেন ইন্দ্রনীল শুক্লা

মুভ’! বললেই বিরাট চক্রাকারে ঘুরছে প্রায় শ’দুয়েক ছেলেমেয়ে৷ আর ‘লাভ সার্কেল ’! বললেই কাছাকাছি যে কয়েকজন থাকছে তারা পরস্পরকে জড়িয়ে জড়িয়ে ছোট ছোট বৃত্ত তৈরি করছে৷ প্রথমে গোলগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ হচ্ছিল না৷ ক্রমে হতে লাগলো৷ আর হাসি ফুটলো নাদিরা জাহির বব্বরের মুখে৷ বলা বাহুল্য, এই ওয়ার্কশপ থিয়েট্রিক্যাল৷

কিন্ত্ত যাঁরা তাঁর এই ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরা ম্যানেজমেন্ট স্টুডেন্ট৷ ঘটনাস্থল ইন্টারন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট৷ সেখানেই কথা বলতে বসলেন এক ফাঁকে৷ স্বাভাবিক কারণেই জানতে ইচ্ছে হল, তাহলে ম্যানেজমেন্ট পড়তে হলেও থিয়েটারের প্রয়োজন ? হেসে ফেললেন, ‘দেখুন, আমি তো মনে করি থিয়েটার প্রত্যেকের জীবনেই প্রয়োজন৷ থিয়েটারে অল্প কিছুটা করে সময় কাটালেও মানুষের পক্ষে কোনও পরিস্থিতি ফেস করা অনেক সহজ হয়৷ আবার কারও সামনে নিজেকে ঠিকঠাক উপস্থাপন করতেও শেখায় থিয়েটার৷ ’

কিন্ত্ত এতখানিই যদি প্রয়োজনীয় তাহলে থিয়েটার কেন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে ? কেন মানুষ থিয়েটার দেখতে সেভাবে ভিড় করেন না ? নাদিরা বলছেন, ‘না , এটা মানতে পারলাম না৷ আমার মনে হয় ব্যাপারটা কিছুটা শিফট করেছে৷ বড় বড় শহরের মানুষরা যেন মোবাইল , গ্যাজেট , নেট , সিনেমা এইসব নিয়েই মেতে আছে৷ কিন্ত্ত তুলনায় ছোট শহরের মানুষ এখনও নাটকের সঙ্গে একাত্ম আছেন৷ তাঁরা নতুন নতুন দল গড়ছেন নাটকের৷ চেষ্টা করছেন৷ এই তো আমি হালে বরেলি গিয়েছিলাম , বেগুসরাই গিয়েছিলাম৷ অনেক নতুন দলকে চেষ্টা করতে দেখলাম৷ ভালো লাগলো খুব৷’এনএসডি থেকে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত, সঙ্গীত-নাটক পুরস্কারজয়ী এই নাট্যশিল্পী একদা স্কলারশিপ নিয়ে জার্মানি গিয়েছিলেন৷

গ্রটস্কি , পিটার ব্রুকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ মিলেছে৷ কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা , জানতে ইচ্ছে হল৷ বললেন , ‘ওখানকার থিয়েটার খুব উচ্চমানের৷ সকলে প্যাশন নিয়ে কাজ করেন সব সত্যি৷ কিন্ত্ত সত্যি বলুন তো ‘মহাভারত ’ ছাড়া পিটার ব্রুকের কথা আর শুনেছেন ? ওঁর প্রতি সমস্ত সম্মান রেখে বলছি , উনি ধারাবাহিকভাবে ভালো কাজ করে যেতে পারেননি৷ প্রচুর অ্যাভারেজ কাজও করেছেন৷ অন্য দেশের থিয়েটার ব্যক্তিত্ব বলেই আমাদের কাঁধ ঝুঁকে যাওয়ার কিন্ত্ত কোনও কারণ নেই৷

জানি আমার মতো করে এই কথাটা এতখানি সাহস নিয়ে খুব কম মানুষই বলেন , কিন্ত্ত দায়িত্ব নিয়ে বলছি নাট্যশিল্প নিয়ে আমরা ভারতীয়রা যথেষ্ট গর্ব করার মতো জায়গায় আছি , ভাবনায় এবং পারফরম্যান্সে৷ আমাদের দেশের নাট্যধারাটা খুব প্রাচীন আর সমৃদ্ধ৷ আমার গুরু ইব্রাহিম আলকাজির কাছে আমি যা শিখেছি তা ওঁদের থেকে শিখতে পারিনি৷ ’রাজ বব্বরের প্রথমা স্ত্রী -র সঙ্গে কথা বলতে বসে , রাজ বব্বরের প্রসঙ্গ একেবারে উঠবে না তা হয় নাকী ? শোনা যায় এনএসডি -তে পড়ার সময়েই তাঁদের প্রেম ! ‘উফফ , অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে৷ ওইসব পুরনো লাভস্টোরির কথা ছাড়ুন তো৷ না এনএসডি -তে ঠিক প্রেম হয়নি৷ হয়েছিল বাইরে৷ ’

ব্যক্তিগত প্রসঙ্গগুলোয় ঢুকতে চাইছিলেন না নাদিরা৷ কথায় কথায় রাজ বব্বর -স্মিতা পাতিল প্রসঙ্গ চলে আসুক, তিনি সম্ভবত চাইছিলেন না৷ তবু স্মিতা অসময়ে চলে যাওয়ার পর রাজ ফিরে এসেছিলেন তাঁর কাছে৷ রাজ একসময়ে রাজনীতিতে যোগ দেন৷ নাদিরার বাবা সাজ্জাদ জাহির বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে৷ রাজনীতিতে আসার সময় কি তিনি নাদিরার পরামর্শ নিয়েছিলেন ? নাদিরা বলছেন , ‘না৷ ওটা ওঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল৷ তাছাড়া রাজ বারো ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ এটা ওঁর হঠাত্ করে আসা নয়৷ ’ছেলে আর্য বব্বর অভিনয়ে যুক্ত৷ মেয়ে জুহিও অভিনয় ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন৷ তাঁদের মা তথা অভিনেতা হিসেবে কোনও পরামর্শ দেন ? একটু ভেবে বললেন , ‘আমি খুব বেশি কাউকে পরামর্শ দেওয়ার পক্ষপাতী নই৷ আমার মনে হয় সকলকে স্বাভাবিকভাবে নিজের মতো করে গ্রো করতে দেওয়া উচিত৷ প্রত্যেকে নিজের সময়ের মতো করে নিজেকে তৈরি করে৷ আমার ভাবনা এই সময়ের সঙ্গে ম্যাচ করবেই এমন ভেবে নেওয়া ঠিক নয়৷ হ্যাঁ, ওরা যখন অভিনয়ের ব্যাপারে আমার কাছে নিজে থেকে এসে কিছু জানতে চায় , অবশ্যই টিপস দিই৷ তাছাড়া , অ্যাকটিং তো একটা পারফর্মিং আর্ট৷ মুখে অনেক কিছু বলে শেখানো যায় না৷ করতে করতে শিখতে হয়৷ ’কমার্শিয়াল ছবিতে খুব কম হলেও কাজ করেছেন নাদিরা৷

‘ব্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস ’ ছবিতে তিনি ঐশ্বর্যা রাইয়ের মা হয়েছেন৷ সলমন খানের মা হয়েছেন ‘জয় হো ’ ছবিতে৷ এঁদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ? অভিনেতা হিসেবে এঁদের কেমন মনে হয় ? নাদিরা বলছেন , ‘ওঁরা কমার্শিয়াল ছবিতে কাজ করেন বলেই ওঁদের খাটো নজরে দেখবো এটা কিন্ত্ত আমার মধ্যে নেই৷ দর্শকের মধ্যে ওঁরা যে রকম ছবিতে কাজ করেন তার চাহিদা তো রয়েছে , তবেই তো ওঁরা কাজ করছেন৷ আর দর্শকের চাহিদার জন্য ওঁরা যে বরফের মধ্যে স্বল্প পোশাকে নাচ -গান করেন , রাজস্থানের মরুভূমিতে প্রচণ্ড গরমে ঘাম মুছতে মুছতে প্রেমের ডায়ালগ দেন , এটাও কিন্ত্ত সহজ কাজ নয়৷ ’

থিয়েটারের লোকজন যে ফিল্মে , সিরিয়ালে কাজ করেন এই ব্যাপারটা তাঁর কেমন লাগে ? ‘খুব ভালো লাগে৷ বিশ্বাস করুন৷ নতুন ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞাসা করলে নিজেই বলি টিভি -ছবিতে কাজ করতে৷ আরে বাবা , কাজটা তো অভিনয়েরই৷ তাছাড়া একজন শিল্পীকে তো খেয়ে -পরে বেঁচে থাকতে হবে !’কলকাতার থিয়েটার দেখেছেন ? ‘এখনকার বাংলা থিয়েটার আমার দেখা হয়নি৷ কিন্ত্ত রুদ্রপ্রসাদ সেনগুন্ত , শম্ভু মিত্র , উত্পল দত্ত এঁদের নাটক একসময়ে ছুটে ছুটে দেখতে গিয়েছি৷ উত্পলদার সঙ্গে অনেক থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে একসঙ্গে ট্র্যাভেলও করেছি৷ অনেক কিছু শিখেছি ওঁর থেকে৷ থিয়েটার করি , কলকাতার থিয়েটার দেখিনি হয় নাকি !’

থিয়েটারটা অন্য রকম করতেই হবে

$
0
0

ব্রিটিশ নাট্যকার কার্ল মিলার সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন৷ সমসাময়িক নাটক, যুবসমাজের ওপর তার অভিঘাত এবং নাটকের ভবিষ্যত নিয়ে নানা কথা হল শতরূপা বসু-র সঙ্গে


সমসাময়িক ব্রিটিশ নাট্যকার কার্ল মিলার গত ১৫ বছর ধরে নিয়মিত ভারতে এলেও, কলকাতায় এলেন এই প্রথম৷ লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার, যা সমসাময়িক থিয়েটার প্রযোজনার আড়ত - তার সঙ্গে যুক্ত মিলার মুম্বইতে আসছেন রাইটার্স ব্লক এবং রজিত কাপুরের থিয়েটার প্রযোজনা সংস্থা রেজ-এর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে৷ এ ছাড়া নিয়মিত কাজ করেন রাহুল দ্য কুনহা, শার্নাজ প্যাটেলদের সঙ্গেও৷

কলকাতায় তাঁর আসা ইউকে-ভারত দ্বিপাক্ষিক সংস্কৃতির বছর উপলক্ষে৷ এ বছরই লন্ডনের বিখ্যাত সমসায়মিক নাটক কিথ গ্রে-র লেখা ‘অসট্রিচ বয়েজ’-এর নাট্যরূপ দিয়েছেন মিলার৷ মুম্বইতে সেই নাট্যরূপ অভিনয় করাচ্ছেন ‘আনন্দ এক্সপ্রেস’ নামে৷ ইতিমধ্যেই মুম্বইতে থিয়েটারটির প্রদর্শন হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম আনন্দ যে বলে সে একটা জায়গায় পৌঁছতে চায়৷ গল্পের শুরুতে আনন্দ একটি পথ দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে৷ তার বন্ধুরা পুলিশ এবং তার পরিবার আসার আগে তার অস্থিভস্ম প্রায় অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে তার প্রিয় জায়গা আনন্দ-এ৷ সেই জার্নির গল্প৷ বন্ধুত্বের গল্প৷ চারজন অভিনেতা মিলে প্রায় ২০-৩০টা চরিত্র করেন৷ কলকাতা ‘আনন্দ এক্সপ্রেস’ দেখবে ৩০শে জুলাই৷

যেহেতু মিলার মূলত যুব সমাজের জন্য নাটক লেখেন, তাঁদের কী ধরনের নাটক লিখতে অনুপ্রেরণা দেন? ‘আমি কখনই বিষয়বস্ত্ত বেঁধে দিই না, কিন্ত্ত একটা কথা বলে দিই - এই মুহূর্তে যেটা ঘটছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ৷ থিয়েটার লেখক হিসেবে সেটা যদি আমরা লিখি তাহলে হয়তো দর্শক ভাববেন সেটা নিয়ে৷ যেমন কিছুদিন আগে একটা নাটক করালাম যেটার ব্যাকগ্রাউন্ড চেন্নােইর মধ্যবিত্ত পরিবার৷ তাদের টাকা পয়সার সমস্যা, জল সরবরাহর সমস্যার কথা বলে৷ কিন্ত্ত ড্রামাটা উড়ান নেয় একটা ঘটনা থেকে যেখানে সেলফোনে সেখানকার একটি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের অন্তরঙ্গ ফোটো তোলা হয়েছে এবং যেটা ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে৷ তার যে এফেক্ট তৈরি হচ্ছে সমাজে৷ এমন কিছু দিক উঠে আসছে যা আমাদের সরাসরি এফেক্ট করছে - যেমন কীভাবে প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে, বা যৌনজীবন, নারী-জীবন নিয়ে আমাদের অ্যাটিটিউড বা আইডেন্টিটির নানা প্রশ্ন৷ মজার ব্যাপার হল লন্ডনে যে ধরণের প্রতিক্রিয়া এটা আনবে, চেন্নাইতে বা মুম্বইতে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি প্রতিক্রিয়া আনবে৷ এটাই ক্ল্যাসিকের সঙ্গে সমসাময়িকের তফাত্,’ বলছেন মিলার৷

তাই মূলত ব্রিটেনে কাজ করলেও নানা আন্তর্জাতিক স্বর শুনে সেটাকে তুলে আনা মিলারের কাজ৷ তবেই নিজেদের থিয়েটারটা ভালো করে করা যায় বলে তিনি মনে করেন৷ ‘আমার মনে হয় না যে একটা নাটককে প্রচুর দর্শক পেতে হবে৷ কিন্ত্ত মোটামুটি একটা দামে যদি একটা একেবারে অন্যরকম একটা থিয়েটার দেখানো যায় তাহলে তার এফেক্ট অনেক বেশি হবে,’ বলছেন তিনি৷ সেটা হতে পারে গ্রামের কোনও বিষয়বস্ত্তও যা শহরবাসীকে ভাবাবে৷ যেমন একটা গ্রামের মধ্যে যদি ফ্লাইওভার বা ফ্যাক্টরি তৈরি হয় তাহলে গ্রামবাসী এবং শহরবাসীকে সেটা কীভাবে এফেক্ট করবে৷ আরেকটি ব্যাপারের ওপরও নজর দেন মিলার৷ ‘লেখা তো আদতে একটা ক্রাফ্ট৷ সেই ক্রাফ্ট থিয়েটারকে কতটা সাহায্য করতে পারে৷ পেশাদার লেখকরা সেটাই আমাদের ওয়ার্কশপে শেখান - কীভাবে লেখাকে পেশাদারিত্বের থেকে মুক্ত করে লেখা যায়,’ বলছেন মিলার৷

এই মুহূর্তে ইংল্যান্ড জঙ্গিহানা, পরিবেশ বদল, এরকম নানা সমস্যা নিয়ে জর্জরিত৷ এ সব নিয়ে কেমনভাবে রিয়্যাক্ট করছে এখনকার ব্রিটিশ যুব সমাজ? ‘ওখানকার থিয়েটার কমিউনিটি গত কয়েক বছর ধরেই এই সমস্ত বিষয় নিয়ে টানা কাজ করছে৷ ডেনিস কেলি, সাইমন স্টিভেন্স, ক্যারল চার্চিলরা জঙ্গিহানা, সেখানকার সিস্টেমকে প্রশ্ন করা নিয়ে কাজ করছেন৷ জঙ্গিহানা নিয়ে লেখার একটা বড় সমস্যা হল কোন দিকটা আপনি বেছে নেবেন - যে দিকটা নিয়ে মিডিয়া ক্রমাগত কথা বলে চলেছে, যেন শেষ না হওয়া একটা আখ্যান, এবং তার সঙ্গে আমেরিকান রাষ্ট্রপতিকে মিলিয়ে দেওয়া, তিনি এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেবেন, ইত্যাদি৷ মুশকিল হল এটা করতে গিয়ে এই সমস্ত ঘটনাকে ফিরে দেখার বা বিশ্লেষণ করার মতো কোনও দূরত্ব তৈরি হয় না৷ নাকি, আপনি অন্য পথে হাঁটবেন - পারস্পরিক নির্ভরতা, জাতীয় সংহতি নিয়ে কথা বলবেন৷ যাঁরা এগিয়ে এসে সেই হামলার ভিক্টিমদের প্রতি সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেবেন৷ জঙ্গিহানার যে মূল উদ্দেশ্য - মানুষের মধ্যে বিভেদ গড়ে তুলে সংহতি ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া - সেটাকে মোকাবিলা করে আটকাবেন - সেই দিকটা তুলে ধরবেন,’ প্রশ্ন তোলেন মিলার৷

চ্যালেঞ্জ আরও আছে৷ যেটা আঘাত করছে একেবারে মূলে৷ নানা কারণে পৃথিবীটা খন্ড খন্ড হয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ ফ্র্যাগমেন্টেড হয়ে যাচ্ছে৷ আমরা ক্রমশ আরও একা, আইসোলেটেড হয়ে যাচ্ছি৷ এটার একটা নিদারুণ উদাহরণ দিচ্ছেন মিলার৷ ‘এখন একসঙ্গে বসে থিয়েটার দেখার কনসেপ্টও বদলে যাচ্ছে৷ একটা ছোট্ট বাচ্চাকে কেউ এখন থিয়েটার দেখাতে নিয়ে যান না৷ বা ধরুণ, থিয়েটার দেখতে বসে দর্শকের মধ্যে মোবাইল ফোন দেখার অভ্যেস অনেক বেড়ে গিয়েছে৷ কারণ তারা আর সমষ্টিগতভাবে ভাবছে না, অন্য লোকের এতে কতটা অসুবিধে হচ্ছে সে সবও ভাবনা থেকে উধাও৷ সেই কানেকশনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷

কিন্ত্ত তার সমাধানও আছে৷ মিলার বলছেন যে ইংল্যান্ডে থিয়েটার মহলে একটা কথা এখন সব আলোচনায় ঢুকে পড়ে৷ সেটা হল নতুন নতুন প্রযুক্তির ভারে থিয়েটারটা কি নষ্ট হয়ে যাবে? ব্যাপারটা অনেকটা এরকম৷ যখন যুক্তি ছিল গ্রামোফোন এলে কি গান গাওয়া বা অন্যের গান শোনা বন্ধ হয়ে যাবে? সিনেমা এলে কি লাইভ পারফরম্যান্স বন্ধ হয়ে যাবে? আই-প্যাড এলে মোবাইল ফোন উঠে যাবে? ‘এখনও পর্যন্ত তো কোনওটাই হয়নি৷ অন্তত আমার দেশে থিয়েটারটা তো হইহই করে টিকে গেল৷ যে কোনও ফিকশন ফর্মেরই গল্প বলার এবং চরিত্র তৈরি করার শক্তি আছে৷ কিন্ত্ত এক ঘর জীবন্ত দর্শক একটা জীবন্ত পারফরম্যান্স প্রত্যক্ষ করার মধ্যে একটা অন্য জাদু কাজ করে৷ সেটা কোনওদিনই পুরনো হবে না৷ তাই লাইভ গল্প বলা থাকবে, শোনাও থাকবে৷ সেই ম্যাজিক এবং থ্রিল কোনওদিনই যাবে না,’ বলছেন মিলার৷


চলে গেলেন কিংবদন্তী নাট্যশিল্পী শোভা সেন

$
0
0

এই সময় ডিজিটাল ডেস্ক: প্রয়াত হলেন প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব শোভা সেন। সকাল ৬টা দক্ষিণ কলকাতার ম্যুর অ্যাভিনিউ-এর বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।

রবিবার সকালে তাঁর পারিবারিক সূত্রে খবরটা প্রকাশ করা হয়। বার্ধক্যজনিত কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। শোভা সেনের মৃত্যুর খবর পেয়েই তাঁকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে যান বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি। দুপুরে বাড়ি থেকে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় প্রয়াত শিল্পীর দেহ। সেখানে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর এনআরএস হাসপাতালে তাঁর মরণোত্তর দেহ দান করা হয়।

প্রখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা উত্‍‌পল দত্তের স্ত্রী ছিলেন শোভা সেন। ১৯২৩ সালে অবিভক্ত বঙ্গের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। বেথুন কলেজের ছাত্রী থাকাকালীনই গণনাট্য সংঘে যোগ দেন শোভা সেন। অভিনয়ের জগতে শুরু হয় তাঁর অবাধ আধিপত্য। তিনি অভিনয় করেছেন টিনের তলোয়ার, নবান্ন, তিতুমির, ব্যারিকেডের মত নাটকে।

এরপর তিনি পা রাখেন চলচ্চিত্রেও। হিন্দি ছবি এক আধুরি কহানি ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। ঋত্বিক ঘটকের পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি বেদেনিতেও শোভা সেন অভিনয় করেছিলেন। তবে ছবিটি শেষপর্যন্ত শেষ করা হয়ে ওঠেনি। বাসু চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ, উৎপল দত্তের অনেক ছবিতেই তিনি অভিনয় করেছেন। এছাড়াও তাঁকে দেখা গিয়েছে জার্মান পরিচালক ফ্লোরিয়ান গ্যালেনবার্গারের বাংলা ছবি শ্যাডোজ অফ টাইমে। থিয়েটারই ছিল তাঁর প্রথম ভালবাসা। ২০১০ সালে তিনি পান মাদার টেরেজা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড।

অভিনয়ের পাশাপাশি বামপন্থী রাজনীতিতেও তাঁকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল শোভ সেনের। চার-পাঁচ বছর আগে অশক্ত শরীরেও তাঁকে নিয়মিত আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দেখা গিয়েছে।

শিল্পীর মৃত্যুতে বিভিন্ন মহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করে তাঁর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন।



#Eminent theatre personality Sobha Sen died. She was 93 years old.

#CM Mamata Banerjee twits, 'Saddened at the passing of veteran theatre artiste Sobha Sen. My condolences to her family and friends.'

বিলীয়মান যুগের যবনিকা

$
0
0

অংশুমান ভৌমিক
কার ও কারও চলে যাওয়ার খবর পেলে ‘একটি যুগের অবসান ’ কথাটা আপনিই ঠোঁটের ডগায় চলে আসে৷ শোভা সেন এমনই একজন৷ এক বিলুন্ত যুগের প্রতিনিধি৷ ১৯৪০ -এর দশকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ঔপনিবেশিক ভারতের এক বিস্তীর্ণ প্রদেশ জুড়ে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চেয়েছিল সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে হাটে -মাঠে পৌঁছে দিতে , বিত্তবৈষম্যের ফারাককে তুড়ি মেরে উড়িয়ে সামন্ততান্ত্রিক উনো জমিতে গণনাট্যের বীজ বুনতে , যার উত্তরসাধক আমাদের ‘গ্রুপ থিয়েটার ’, শোভা সেন চলে যেতে সেই যুগের উপর যবনিকা পড়ল৷ আজ থেকে ৭২ বছর আগে , ১৯৪৩ সালে বিজন ভট্টাচার্য-শম্ভু মিত্রের হাতে তৈরি গণনাট্য সঙ্ঘের ‘নবান্ন ’ বদলে দিয়েছিল আধুনিক নাটকের অভিমুখ৷ সেই ঐতিহাসিক প্রযোজনার অন্যতম নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন শোভা৷ কলকাতার শান বাঁধানো মঞ্চে নয় , ভ্রাম্যমাণ সাংস্কৃতিক সেনানী হয়ে জনজাগরণের বীজতলি তৈরি করতেন তাঁরা৷

গণনাট্যের গাঙে জোয়ার আসেনি তো কী হয়েছে , ১৯৪৭ সালের পর , বহুরূপী গড়ে উঠতে না -উঠতে উত্পল দত্তকে পাশে নিয়ে লিটল থিয়েটার গ্রুপ গড়ে তুলেছেন শোভা৷ শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক নাট্যের নায়িকা হয়েছেন৷ লিও তলস্তয় , ম্যাক্সিম গোর্কি, অদ্বৈত মল্লবর্মনের লেখাকে নাট্যরূপ দিয়েছেন উত্পল , প্রধান নারী চরিত্রে রূপদান করেছেন শোভা৷ ‘ম্যাকবেথ ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম ’, ‘অঙ্গার ’, ‘কল্লোল ’, ‘টিনের তলোয়ার ’, ‘ব্যারিকেড ’--- তালিকা দীর্ঘ৷ ছয়ের দশকে মিনার্ভা থিয়েটার লিজ নিয়ে একের পর এক স্মরণীয় নাট্যনির্মাণ করেছে এলটিজি৷ মধ্যমণি সেই শোভা৷ ১৯৬৭ সালে নকশাল আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে এই মিনার্ভাই যখন স্বপ্নালু ছাত্র -যুবদের সদর দন্তর হয়ে উঠেছে , তখনও নেতার অনুপস্থিতিতে দল চালিয়েছেন নেত্রী৷ পরে দল ভেঙে গড়ে উঠেছে পিপলস লিটল থিয়েটার , প্রসেনিয়াম থেকে না -সরেও উত্পলনাট্য প্রসারিত হয়েছে যাত্রার জনপ্লাবনে৷ সর্বত্র স্বামী দেখেছেন শিল্পের দিক , আর দলের ভাঁড়ার আগলে স্ত্রী জুগিয়ে চলেছেন রসদ৷

জীবনে ও শিল্পে হাত ধরাধরি করে চলা এমন কমরেড দম্পতি আমাদের সংস্কৃতিতে বিরল৷ তাঁর আত্মজীবনী ‘নবান্ন থেকে লালদুর্গ’-র পাতায় পাতায় রয়েছে এই সংগ্রামের ধারাবিবরণী৷ থিয়েটারের পাশাপাশি সিনেমাও করেছেন৷ মৃণাল সেন , উত্পলের ছবি ছাড়াও একেবারে মেনস্ট্রিম ছবিতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে৷ ১৯৯৩ সালে উত্পলের প্রয়াণের পর পিএলটি যে থেমে যায়নি , তার এক ও অদ্বিতীয় হেতু শোভা সেন৷ দশক দেড়েক আগে ‘নটী ’ নাটকের অনেকটাই জুড়ে ছিলেন তিনি৷ তার পর আস্তে আস্তে মঞ্চে তাঁর ভূমিকা হ্রস্ব থেকে হ্রস্বতর হয়েছে৷ সরেও গেছেন বেশ কিছুকাল৷ কিন্ত্ত সরেননি নাট্যক্রিয়া থেকে৷ পিএলটি ও উত্পল দত্ত ফাউন্ডেশনের যূথপ্রধান হয়ে নেপথ্যেই সক্রিয় ছিলেন৷ কয়েক বছর আগে পর্যন্ত জনসমক্ষে এসেছেন৷ কামদুনি গণধর্ষণের পর কলকাতা জুড়ে নাগরিক প্রতিবাদে নেমেছেন৷ যাদবপুরে বামপন্থীদের প্রতিবাদী সমাবেশে সামিল হয়েছেন৷ বার্ধক্যজনিত শিথিলতা বা স্নায়বিক দুর্বলতা কোনওটাই তাঁকে পথের লড়াই থেকে দূরে রাখতে পারেনি৷

অন্ধকারে নীলচে আলোয় জেগে গাছগুলো

$
0
0

ইন্দ্রনীল শুক্লা
অনেক কিছুই ঘটছে চারপাশে৷ রাস্তা চওড়া করার জন্য যশোর রোডে গাছ কাটার আয়োজন৷ ক্ষমতা -সমর্থিত মানুষের তাড়া খেয়ে টেবিলের তলায় পুলিশের লুকিয়ে পড়া৷ কলেজের বয়স্ক অধ্যাপককে ঘিরে ছাত্রনেতাদের অকথ্য গালি -গালাজ৷ খবর সংগ্রহ করতে আসা সাংবাদিকদের পুলিশি প্রহার৷ একটি স্কুলের হেডমাস্টারমশাইকে চুলের মুঠি ধরে চড় কষিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমনও তো দেখা গেল৷ অর্থাত্ কীনা এইসব ঘটছে৷ প্রকাশ্যেই ঘটছে৷ মিডিয়ার ক্যামেরার সামনেই ঘটছে৷ ঘটুক না৷ কে দেখছে বয়েই গেল৷ কিন্ত্ত এইসবের কোনও প্রতিফলন কি নাটকে পড়বে না ? নাটকটা কি কেবল বিনোদনী হয়েই থেকে যাবে ?

এইসব ভেবে নাটকের এক শ্রেণির সিরিয়াস দর্শক যখন হতাশায় ভুগতে শুরু করেছিলেন , তখনই এল ‘কোজাগরী ’৷ এক্কেবারে ছিপি খোলা লেমনেডের মতোই বীভত্স ঝাঁঝ নিয়ে৷ হজম না হওয়া বিনোদনী -বায়বীয় নাটকগুলোকে এক ঢেকুরে পাকস্থলীতে থেকে সরিয়ে দেবে৷ এ নাটক হাওয়ার্ড ফাস্ট -এর ‘সাইলাস টিম্বারম্যান ’ আশ্রয়ে রচিত৷ তবে মূল কাহিনিকে অতি চমত্কারভাবে এই দেশ , এই রাজ্যের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে৷ একটি কলেজের পিছনে রয়েছে একটা মাঝারি মাপের জঙ্গল৷ সেই জঙ্গল সাফ করে কাঠের টাকা পকেটে পুরতে মরিয়া কিছু ক্ষমতাসীন মানুষ৷ আর তারই প্রতিবাদ করছেন শৈলেশ নামের এক অধ্যাপক৷ বলিয়ে কইয়ে , হম্বিতম্বি করা কোনও দাপুটে ‘হনু’ তিনি নন৷ কিন্ত্ত আর কিছু না থাকুক , গাছ বাঁচাতে তাঁর জেদটা বড্ড জেনুইন৷ তাই কলেজের অধ্যক্ষকে দিয়ে থ্রেট করিয়ে , ফোনে হুমকি দিয়ে , গায়ে ধাক্কা মেরে তাঁকে থামানো গেল না৷ পুরোপুুরি উল্টো একটা ফল হল৷ যত তাঁকে থামানোর চেষ্টা হল , ততোই তিনি আগুয়ান হলেন৷ বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন৷ ভীতু একটা মানুষের প্রতিবাদের লতানো গাছটা পরিণত হল এক মহাদ্রুম -এ৷

আর তারই শাখা -প্রশাখায় বিস্তার লাভ করলেন আরও বহু মানুষ৷ সহকর্মী , কিশোর প্রমুখ৷ নাটকের আঙিনায় ‘কৌশিক ’-এর সমনামীর সংখ্যাটা বিপুল৷ কিন্ত্ত যাঁরা জানেন , তাঁরা জানেন , ‘শান্তিপুরের কৌশিক ’-এর কাজের স্টাইলটা বড় আলাদা৷ স্টারডমের কোনও জায়গা রাখা নেই৷ অচেনা , অল্প চেনা অভিনেতাদের দিয়ে কতখানি শক্তিশালী প্রোডাকশন তৈরি করা যায় , তা তিনি দেখালেন৷ জগঝম্প স্টেজ -ক্রাফ্ট নেই৷

বাদ্যযন্ত্রের দমদমি নেই৷ নাটকে যা আছে , তা একান্ত থিয়েট্রিক্যাল৷ প্রকাণ্ড একটা কুঠার ঝুলে আছে উপর থেকে৷ সে কুঠারের চোখ -ও আছে লাল -কাজলে রাঙা৷ রাষ্ট্রশক্তি মাথার উপর যে খাঁড়াটি সারাক্ষণ ঝুলিয়ে রাখেন তা বোঝাতে কি সহজ অথচ অব্যর্থ এক প্রয়োগ৷ প্রত্যেকবার যখনই কোনও টেনসন তৈরি হচ্ছে , তখনই দর্শকের ঘাড়ের কাছে একটা শিরশিরে অনুভূতি গড়ে উঠছে , এই বুঝি কুঠারটা নেমে এল গিলোটিনের ব্লেডের মতো৷ শোনা যায় একবার স্ক্রিপ্টের সঙ্গে খাপ খাইয়ে খুব কম আলোয় তৈরি করা এক আলোকসজ্জা প্রসঙ্গে তাপস সেন বলেছিলেন , ‘এ নাটকে আমি আলো নয় , অন্ধকার তৈরি করতে চেয়েছি !’ অনুরূপ ব্যাপার ঘটেছে এই নাটকে৷ আলো খুব চড়া হতে পারেনি কখনওই৷ একেক সময় তো প্রায় অন্ধকার৷ শুধু ঝকঝক করেছে ঝুলতে থাকা কুঠার ! মানুষের ভয় , তাকে ধমকে চুপ রাখার প্রয়াস , ষড়যন্ত্রের রচনা , প্রতি আক্রমণ এইসবই তো আবছায়ার মধ্যে বাস করে৷ তাই আলোকেও হতে হয়েছে রহস্যময়৷ প্রথমে শান্ত , ম্রিয়মাণ থাকা এবং ক্রমে প্রতিবাদে গর্জে ওঠা শৈলেশের ভূমিকায় অশোক মজুমদারের অভিনয় অনেকদিন মনে থাকবে৷

আসলে শৈলেশ তো কেবলমাত্র প্রতিবাদী কন্ঠ নয় , সে আমাদের বার বার মনে করায় যে ক্ষমতার বিকৃত প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলাটা মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন৷ তাই অন্ধকারের মধ্যেও এই ছোট ছোট প্রতিরোধগুলোই আমাদের স্বপ্ন দেখায় সুস্থ , স্বাভাবিক গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখার৷ প্রতিবাদ সভায় দর্শক আসন থেকে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংসদ নেতাদের লাফিয়ে মঞ্চে উঠে পড়া , গালি দেওয়ার দৃশ্যটা ভোলার নয়৷ নাটক যেখানে শেষ হয় সেও বড়া প্রশান্তির৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে নীলচে আলোয় জেগে রয়েছে সেই গাছগুলো , শান্ত , সমাধিস্থ হয়ে৷ মনের ভিতর কোথাও যেন প্রার্থনা জেগে ওঠে , কুঠার যেন এদের উপর আছড়ে না পড়ে !

দহনে, খননে মহাকাব্যিক খোঁজ

$
0
0

ইন্দ্রনীল শুক্লা
এ নাটকে রয়েছে মহাভারতের একটি পর্ব, যার সংলাপ রচনায় ব্রাত্য বসু৷ নাটকের চরিত্রগুলি হল সূত্রধার , তিন বৃদ্ধ, ধৃতরাষ্ট্র , দুর্যোধন , বিদুর , পুরোচন , বীভত্সু, যুধিষ্ঠির , কুন্তী , নিষাদী মা ও তার পাঁচ পুত্র৷ এ ছাড়া কোরাস হিসেবে মঞ্চে আসবেন আরও অনেকে৷ ঘটনাস্থল বারণাবত৷ একদিকে পুরোচন , বীভত্সু-রা জতুগৃহ গড়েছে দুর্যোধনদের পরামর্শে, অন্যদিকে সুড়ঙ্গ খোদাইয়ের লোককে গোপনে নিয়োগ করেছেন বিদুর , যাতে তারা পালিয়ে যেতে পারে৷ কিন্ত্ত সাদামাটা পালানো নয় , পাণ্ডবরা যাওয়ার আগে ওই বাড়িতে আশ্রিত নিষাদী মা ও তার পাঁচ পুত্রকেও জ্বালিয়ে দেয় , যাতে কৌরব ভাইরা মনে করে যে বাড়ির সঙ্গে সঙ্গেই পাণ্ডবরাও সকলে ভষ্ম হয়েছে৷ উল্লেখ করা দরকার , ব্রাত্য সম্ভবত এই প্রথমবার মহাভারতের ভিত্তিতে টেক্সট রচনা করছেন৷

মনে প্রশ্ন আসতেই পারে কেন মহাভারত ? সহজ করে উত্তর দিতে গেলে বলা যায় , এ নাটকে মহাভারত একটা প্রেক্ষাপট৷ আমাদের সকলের ভিতরেই একটা জতুগৃহ রয়েছে৷ যা আমাদের পোড়ায় , ধ্বংস করে৷ আবার এটাও সত্যি যে আমাদেরই নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য পরিখা খনন করে যেতে হবে৷ না হলে পরিত্রাণ নেই৷ আরও একটু এগিয়ে বলা যায় যে কাহিনিটা মহাভারতের একটা পর্ব থেকে নেওয়া হলেও ব্রাত্য বসুর এই নাটকটা এখনকার সময়টাকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে৷ খেয়াল করলেই বুঝতে পারা যাবে যে সমসাময়িক রাজনীতিটা নাটকের মধ্যে রয়েছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাত্য বসু ‘নাকি ’ রাজনৈতিক নাটক আর লিখছেন না বলে যে কথাটা অনেকে বলছেন , তাঁদের কিন্ত্ত এই নাটকটা দেখতেই হবে৷ দুর্যোধন নাটকে ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন , ‘পিতা , ভুলে যাবেন না রাষ্ট্রযন্ত্র আজ আমাদের হাতে৷ এই সম্পূর্ণ যন্ত্র ও পদ্ধতি দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে ওদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবো৷ ’ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর নেতাদের সর্বগ্রাসী যে মানসিকতা রাতারাতি দানা বাঁধে তা দুর্যোধনের এই কথায় স্পষ্ট উঠে আসছে৷ কিংবা কুন্তী যখন যুধিষ্ঠিরকে বলেন , ‘... যুদ্ধে , জীবনে একদল মারে , একদল বাঁচে , মাঝখান থেকে শুধু স্তূপাকারে লাশ জমে ওই নিষাদী আর তার পাঁচ পুত্রের৷ যুগের পর যুগ৷ ওরা বিশ্বাস করে সবাইকে৷ তাই ঠকে ’--- তখন সমসাময়িক রাজনৈতিক মেটাফোর যে অত্যন্ত শক্তিশালী তা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না৷ যুগে যুগে অনুগামীরা নেতাদের বিশ্বাস করে এসেছেন , দলের আদর্শ আর নীতির অনুসরণ করেছেন৷ কিন্ত্ত এই প্রশ্ন তাঁরা তোলেননি বলেই হয়ত তার সুযোগ নিয়ে গিয়েছে অন্য অন্য সুযোগসন্ধানীরা৷ এমনই প্রচুর পরোক্ষ উপমা , মেটাফোরের ব্যবহার রয়েছে নাটকে৷ পুরোচন , বীভত্সুদের মতো চরিত্রগুলো এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷ পরিচালনার পাশাপাশি কৌশিক চট্টোপাধ্যায় অসম্ভব ভালো অভিনয় করলেন দুর্যোধনের ভূমিকায়৷

কিন্ত্ত তিনি যেন যথেষ্ট সঙ্গত পেলেন না বাকি অভিনেতাদের থেকে৷ পোশাক , মিউজিকেও আর একটু মনোযোগী হওয়া দরকার ছিল অন্তত এ নাটকের গ্রাঞ্জারের সঙ্গে তাল মেলাতে৷ ব্রাত্য যে রকম একটা ক্ল্যাসিক বাংলা এ নাটকের জন্য ব্যবহার করেছেন তা সত্যিই দুর্দান্ত৷ আর মহাভারতের প্রেক্ষাপট ? যা নেই ভারতে , তা নেই ভারতে --- এই কথাটা যে কতখানি সত্যি তা পরতে পরতে অনুভব করা গেল৷ মহাভারতের কাল নিয়ে নির্মিত হলেও মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, রাজনীতি , কূটনীতির জটিল আবর্ত এই সবই আশ্চর্য রকম ভাবে অনুভব করা গিয়েছে নাটকের মধ্যে৷ কবিতার মতো ভাষা আর অন্তরের দহন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে৷ নাহলে কাহিনিটা তো আমাদের সকলেরই জানা : দুর্যোধনের সমস্ত ঈর্ষা আর আক্রোশ একাকার হলে সে স্থির করল পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠাবে৷ দুর্যোধনের আদেশে পুরোচন নির্মাণ করল জতুগৃহ৷ বিদুরের নির্দেশে সুড়ঙ্গখনক সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চলল পাণ্ডবদের রক্ষা করতে৷ পাণ্ডবরা রক্ষা পেল৷ পুড়ে মরল এক নিষাদ পরিবার৷ কিন্ত্ত এই সময়ে দাঁড়িয়ে বিচার করলে বুঝতে পারা যায় যে আজকের দেশের নানা ঘরও প্রস্ত্তত রয়েছে বুকে বারুদ নিয়ে , আর মনের বারণাবতে জ্বলছে আগুন৷ বলা বাহুল্য যে কানেক্ট করা যাচ্ছে৷ এখন কথা হল , কেমন করে এর থেকে মুক্তি পাবে মানুষ ? খোঁজ জারি রাখতেই হবে৷ তাই চালিয়ে যেতেই হবে মনের ভিতর এক ক্রম -খনন৷ বিদুর তো এ নাটকে বলেইছেন : ‘জাগো৷ ঘুমিও না৷ জাগো৷ জেগে ওঠো নিজের গভীরে৷ ’

দুর্গের পাঁচিলে ‘পাগলা ’ রাজা

$
0
0

ইন্দ্রনীল শুক্লা
এক প্রধানমন্ত্রীর হঠাত্ ঘোষণা৷ বিমুদ্রাকরণ৷ লক্ষ লক্ষ নোট বাতিল এক নিমেষে৷ বাতিল টাকা জমা দেওয়ার ভিড়৷ নতুন টাকা তুলতে এটিএমে লাইন৷ লোকসভা ভোটের ঠিক আগে বাংলার এক মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি গেলেন এক নামী সমাজসেবককে নিয়ে মিলিত সভা করতে৷ কিন্ত্ত সেই ব্যক্তি সভায় এলেন না৷ ভেস্তে গেল সভা৷

ডালহৌসি স্কোয়্যারের পাশে ব্রিটিশ নির্মিত এক প্রাসাদ ছিল রাজ্যের পাওয়ার সেন্টার৷ পরিবর্তন ঘটে সেই ক্ষমতাকেন্দ্র চলে গেল গঙ্গার ওপারের শহরে , নব -নির্মিত এক বহুতলে৷

শুনে আপাতভাবে মনে হওয়া স্বাভাবিক যেন গত কয়েক বছরের কিছু খবর খামোখা এনে জড়ো করা হল নাটকের আলোচনায়৷ যেন অকারণ৷ কিন্ত্ত শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে যে ১৯৬৪ সালে গিরিশ কারনাডের লেখা এক নাটকে এই সমস্ত ঘটনা ছিল৷ কেমন করে তা সম্ভব ? ভবিষ্যত্বক্তা ছিলেন নাট্যকার ? একেবারেই নয়৷ বরং ফিরতে হবে সেই পুরনো মতের কাছে : ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে৷ ভারতের ইতিহাসে ‘পাগলা রাজা ’ হিসেবে পরিচিত মহম্মদ বিন তুঘলকের সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যেন স্থান -কাল -পাত্রে পরিবর্তিত হয়ে আবার ফিরে এল৷ তুঘলকের তৈরি করা মুদ্রা জাল হয়েছিল৷ শোনা যায় , প্রাসাদের মাঝে উদ্যানে ডাঁই করে রাখা নকল মুদ্রার মাঝে বসে কি সব ভাবতেন তিনি , আর বিড়বিড় করতেন ! এক ধর্মগুরুকে সভা করার জন্য ডেকে সেই সভা যাতে পণ্ড হয় , আড়াল থেকে তা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি৷ আর তিনি যে রাজধানী দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে নিয়ে গিয়েছিলেন তা সকলেরই জানা৷ সেই সবেরই উল্লেখ আছে এই নাটকে৷

জওহরলাল নেহরুর প্রয়াণবর্ষে নাটকটা রচনা করেন কারনাড৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নেহরুর হাত ধরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এক শ্রেণির মেধাবী মানুষ , তাঁদের হতাশাই যেন ফুটে বেরিয়েছিল তুঘলকের কথা আর দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে৷ ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের হাতে পড়ে মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিকথার যে সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়েছিল , তার ভূত ঘাড় থেকে নামানোর তোড়জোড়ের মুখেই ‘তুঘলক ’-এর আগমন৷ সেই থেকে সারা ভারতেই বার বার বড় পরিচালকরা নিজেদের মতো করে তুঘলককে আনেন মঞ্চে৷ ‘পাগলা রাজা ’-র কুয়াশা কাটিয়ে বুদ্ধিমান মানুষ চিনতে শুরু করেন এক স্বপ্নপথিককে৷ দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ও এই শহর , এই সময় , এই দেশ , এই পরিবর্তনকে ব্যাকড্রপে রেখে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন তুঘলককে , যিনি সাম্প্রদায়িক নন , যিনি সংস্কারের স্বপ্ন দেখেন৷ কারনাড এক জায়গায় বলেছেন , ‘দিল্লিতে আসা সুলতানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে ইন্টেলিজেন্ট , সবচেয়ে আইডিয়ালিস্টিক ... কিন্ত্ত তাঁর ভিতরে যে স্ববিরোধিতা ছিল , দ্বিধাগ্রস্ততা ছিল , তার জন্যই মানুষ তাঁকে ভুল বুঝেছে৷ তিনি ব্যর্থ হয়েছেন !’ নাটক জুড়ে আমরা আসলে এক ট্র্যাজিক নায়ককে দেখতে পাই৷ শুরুতে অন্ধকার মঞ্চের মাঝে একটা স্পট আলোয় শুধু তুঘলকের মুখটা দেখা যায়৷

আশেপাশের মানুষের দিকে নয়৷ তিনি চেয়ে আছেন অনেক দূরে৷ যাঁর ভাবনা সম -সময়ের থেকে কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে৷ যিনি হিন্দুদের অত্যাচার করে শোষণের পথে হাঁটতে চাইছেন না৷ সকলকে নিয়ে চলতে চাইছেন৷ নতুন রাষ্ট্রীয় নীতি আনতে চাইছেন৷ কিন্ত্ত আইনের ফাঁক গলে সেসব সুবিধা অন্য কিছু সুযোগসন্ধানী নিয়ে চলে যাচ্ছে না তো ? যাঁদের জন্য তিনি এতকিছু করতে চাইলেন তারা হয়তো একই রকম রয়ে গেল ! যুগে যুগে তো এমনটাই হয়৷ সরকারি নানা গরিবি হঠাও যোজনার সুযোগ ক’জন গরিব পান ? তুঘলক -এর ভূমিকায় অসম্ভব ভালো অভিনয় করলেন রজতাভ৷ বাকি অভিনেতারা তাঁকে উপযুক্ত সঙ্গত করলেন৷ আর সিন পরিবর্তনের অংশগুলোকেও নাটকের অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন দেবেশ৷ হ্যাঁ, নাটকের মাঝে সুলতানের ধর্ষকামিতা , দুর্নীতি , নিষ্ঠুরতা চোখে পড়বে৷ তাঁর মতো দেখতে একটা মানুষকে যুদ্ধক্ষেত্রে সামনে রেখে নিজের বিপদ কাটিয়ে ফেলেন তিনি৷ কিংবা নিজের প্রিয় বন্ধু, ছোটি আম্মি কাউকেই রেয়াত করেন না৷ আবার , এক শঠ -ধূর্ত মানুষের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান৷ তাঁর মনে হয় , রাজ্য পরিচালনা করতে গেলে দুর্বল হলে চলে না , ধূর্ত-সতর্ক না হলে টিকে থাকা যায় না৷ দুর্গের ছাদে তিনি যখন দাঁড়িয়ে থাকেন , তিনি একা৷ ভাঙা -গড়ার সমীকরণের পাঁচিলে স্থির দাঁড়িয়ে এক ‘পাগল ’!

Viewing all 222 articles
Browse latest View live


<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>