Quantcast
Channel: Eisamay
Viewing all articles
Browse latest Browse all 222

রবীন্দ্রনাথ কি জেলে ছিলেন?জেলবন্দির প্রশ্নে নির্বাক নাট্যকার

$
0
0

তাঁর অভিজ্ঞতা শুনলেন সঞ্জয় বিশ্বাস


তিনি জেলের ভাত খেয়েছেন অনেকদিন। কিন্তু জেল খাটেননি কখনও। তবে বরাবরই কৌতূহল ছিল বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের উঁচু পাঁচিলের ভেতরের জগৎ নিয়ে। ২০০৬ সালে তৎকালীন এডিজি বি ডি শর্মার আগ্রহে সেই সুযোগ মিলে যায় বহরমপুরের প্রদীপ ভট্টাচার্যের। থিয়েটারের অন্যতম মুখ সেখানে। গোটা ১৫ সিরিয়াল আর ৫০টির বেশি সিনেমায় অভিনয়ের দৌলতে তাঁর নামডাক যথেষ্ট। ফলে তাঁর মতো মানুষকে দিয়ে বন্দিদের নিয়ে নাটক করা যায় কিনা ভেবে দেখতে বলেন এডিজি।

মূলত তিনটি কারণে প্রস্তাবটা লুফে নেন প্রদীপ। প্রথমত, জেলবন্দিদের জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ। দ্বিতীয়ত, জেলের সঙ্গে উৎপল দত্তের নাট্যজীবনের একটা যোগসূত্র। তৃতীয়ত, স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বহু মনীষীকে কাটাতে হয়েছিল বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। কোন সেলে, কী ভাবে থাকতেন সেই সব স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, জানার ইচ্ছা ছিল এ গুলোও।

২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হয় নতুন লড়াই। ডিম ফুটে বাচ্চা, তাকে বড় করা, পাখা মেলে আকাশে ওড়ার আত্মবিশ্বাস-সবটাই করা হল থিয়েটার থেরাপির মাধ্যমে। পাঁচিলের এ পার থেকে এক ব্যাগ অক্সিজেন নিয়ে তিনি ঢুকতেন জেলের ভিতরে। তারপর অভিনয়ের আনন্দ দিয়ে ভরিয়ে দিতেন বন্দিদের। অলকানন্দা রায় বন্দিদের প্রতিভাকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিলেও জেলবন্দিদের নিয়ে প্রথম কাজটা কিন্তু শুরু করেছিলেন প্রদীপই, মানছেন কৌশিক পাল। দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বন্দিদের নিয়ে সম্রাট বসুর সঙ্গে 'ময়মনসিংহ গীতিকা' করেছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, 'শব্দেরও যে শক্তি আছে, তা যে মানসিক পরিবর্তনে সাহায্য করে, তার প্রমাণ পেয়েছি বন্দিদের নিয়ে কাজ করার সময়।'

২০ জন যাবজ্জীবন কারাবন্দিকে নিয়ে শুরু হল প্রদীপের নতুন অধ্যায়। বেশিরভাগ কার্যত নিরক্ষর। সকলেই প্রান্তিক চাষি পরিবারের। কেউ ৭ বছর, কেউ আবার ১৭-১৮ বছর পার করেছেন কারাগারের অন্তরালে। সকলেই মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। সন্দেহপ্রবণ। কড়া শাসনের ভয়ে মুখে কিছু না-বললেও সকলের চোখে সন্দেহের উঁকি। ফলে বন্দিদের কাছে 'বিশ্বাসযোগ্য' হয়ে ওঠাটা প্রদীপের কাছে ছিল মস্ত বড় একটা চ্যালেঞ্জ।

দিন কুড়ি পর মেঘ কেটে রোদ্দুরের উঁকি। প্রদীপ বলেন, 'একদিন ওঁদের সঙ্গে বসে জেলখানার দেওয়া খাবার ভাগ করে খেলাম। ঠিক পরের দিন থেকে বদলে গেল চোখের ভাষা। এ দিকে কারাকর্তাদের চাপ বাড়ছে। তাঁরা বলছেন, ও মশাই নাটক ধরুন। হাসির নাটক। বুঝতেই তো পারছেন কাদের নিয়ে কাজ করছেন।' প্রদীপ অবিচল, 'ইতিমধ্যে জেল কোড, জেল প্রশাসন ও কারাবন্দি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ায় আমার মনে হয়েছিল, জেল প্রশাসন অনেকটা রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ-এর মতো। এই নাটকটা সহজেই অন্তরে গেঁথে যাবে বন্দিদের। ও দিকে বহরমপুর জেলের কর্তারা আড়ালে হাসছেন। তাঁরা বলছেন, ওদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথ? এটা কি পাগলামো?'

নাটকের জন্য ৬ জন মহিলা বন্দি লাগবে শুনে প্রদীপের পাগলামি সম্পর্কে ওদের ধারণা সপ্তমে চড়ল। 'আরে বাবা, জেল কোডে ছেলে ও মেয়ে বন্দিদের একসঙ্গে থাকার অনুমতি নেই', বললেন কারাকর্তারা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁর কথার উপর বিশ্বাস রেখে এডিজি কারা অনুমতি দিলেন। ছ' জনের মধ্যে পাঁচ জনই মুসলিম মহিলা। একজন দেহাতি। ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া আইনি অনুশাসনের ভারে ক্লান্ত মানুষগুলো খুঁজে পেলেন আত্মপরিচয়। প্রশাসনের কানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর পৌঁছতেই ওঁরা নড়েচড়ে বসলেন। অবশেষে ২৬ নভেম্বর কারা প্রাচীরের মধ্যে এডিজির উপস্থিতিতে মুক্তমঞ্চে 'তাসের দেশ' অভিনয় করলেন বন্দিরা।

২০০৭ সালের ১৭ মে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে 'তাসের দেশ' মঞ্চায়ন হল। দিল্লিতে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালেও নাটক করার সুযোগ পেলেন বন্দিরা। এরপর করা হল তোতাকাহিনী, রক্তকরবী। গত বছরও দিল্লিতে এনএসডির ফেস্টিভ্যালে রক্তকরবী অভিনয় করেন বন্দিরা। কোনও পুলিশই পাহারা ছাড়াই তাঁদের ট্রেনে করে দিল্লিতে নিয়ে যান প্রদীপ। এ বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রিহার্সাল হয়েছে বন্দিদের নিয়ে। তারপর করোনার কারণে বন্দিরা প্যারোলে মুক্ত হয়ে চলে যান যে যাঁর বাড়িতে। আর ঘরবন্দি হয়ে পড়েন পরিচালক। এটাই ট্র্যাজেডি।

অভিনয় শেখাতে শেখাতে হঠাৎ এক বন্দির প্রশ্ন শুনে অনেকক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি নাট্যকার। 'রবীন্দ্রনাথ কোনওদিন জেলে ছিলেন? যদি না থেকে থাকেন তা হলে রক্তকরবীতে বন্দিদের নিয়ে এ রকম নাটক লিখলেন কী করে?' প্রদীপ বলেন, 'সেই প্রশ্নের উত্তর আমি ওদের দিয়েছি। তবে খুশি হয়েছি, ওদের মনে প্রশ্ন জেগেছে বলে।' তাঁর গলায় তৃপ্তি, 'সেদিনই মনে হল, জেলখানা হয়ে উঠেছে সংশোধনাগার।'


Viewing all articles
Browse latest Browse all 222

Trending Articles



<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>